আজকে আমরা আলোচনা করবো বিনিময় এবং বণ্টন নিয়ে। অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানে বিনিময় এবং বণ্টন খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। আবার বিনিময় এবং বণ্টনকে পরস্পর সম্পর্কিত মনে করা হয়। এর পেছনে একটা কারণ অনুমান করা যায়। আপনারা আগেই জানেন নৃবিজ্ঞানীরা প্রধানত ইউরোপ থেকে অন্যান্য সমাজ দেখতে গিয়েছিলেন।
ইউরোপের সমাজে তখন বাজার ব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী। সমাজে উৎপাদিত দ্রব্যাদির বিনিময় হবে বাজারে – এটাকেই স্বাভাবিক মনে হয়েছে তাঁদের কাছে। কিন্তু ইউরোপের বাইরে অন্যান্য সমাজে গিয়ে এই ধারণাটা একেবারেই পাল্টে গেছে তাঁদের জন্য। সকল সমাজে সেরকম বাজার ছিল না। ফলে কিভাবে ঐ বিশেষ সমাজের মানুষজন উৎপাদিত দ্রব্যাদি আদান-প্রদান করে থাকে সেই জিজ্ঞাসাটা বড় হয়ে দেখা দিল। আবার, আপনারা খেয়াল করে দেখবেন যে বিনিময় এবং বণ্টন ধারণা দুটো অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু প্রচলিত অর্থশাস্ত্র এই সকল সমাজ নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখায়নি যে সকল সমাজে নৃবিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন। অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের সূত্রপাত নিয়ে আলোচনায় তা আপনারা দেখেছেন।
বিনিময় এবং বণ্টন
এখানে আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার যা নিয়ে তালগোল বেধে যেতে পারে। বিনিময় এবং বণ্টনকে একত্রে ভাবা হয় কেন? একটু চিন্তা করলেই এ দুয়ের সম্পর্কটা বোঝা যাবে। সমাজে যা কিছু উৎপাদিত হয় তা ঐ সমাজের মানুষজনের কাছে আপনা-আপনি পৌঁছে যায় না। যে প্রক্রিয়ায় সেইসব দ্রব্যাদি মানুষজনের কাছে যায় তার নাম বণ্টন। আবার সবাই সব কিছু উৎপাদন করেন না। যিনি একটা বিশেষ জিনিস উৎপাদন করেন তাঁর জীবন যাপনের জন্য কেবল ঐ বিশেষ জিনিসের উপর নির্ভর করলে চলে না। অন্যান্য জিনিসও দরকার পড়ে।
সেক্ষেত্রে তিনি তাঁর উৎপাদিত দ্রব্যাদি অন্যের সঙ্গে বদল করতে পারেন। এভাবে এটা বিনিময় করা হচ্ছে। সুতরাং, বণ্টনের সঙ্গে বিনিময়ের সম্পর্ক রয়েছে। তবে এগুলো হচ্ছে আদর্শ অবস্থার কথা। বাস্তবে অগ্রসর পুঁজিবাদী সমাজে দেখা যায় বহু সংখ্যক মানুষ উৎপাদনের জন্য খাটাখাটুনি করেন কিন্তু বিনিময় করবার জন্য তেমন কিছুই হাতে থাকে না।
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকদের এই অবস্থাকে বিবেচনায় রাখা দরকার। পুঁজিবাদী সমাজে সকল বিনিময় হয়ে থাকে বাজারে এবং বিনিময় করবার জন্য শ্রমিকের কেবল নিজের শ্রম থাকে। সেই শ্রম বিক্রি করে তিনি মজুরি পান। সে কারণে পুঁজিবাদী সমাজে এই শ্রমের বাজারকে শ্রমবাজার বলা হয়। আবার পুঁজিবাদী সমাজেই এমন অনেক মানুষ এবং সামাজিক গোষ্ঠী আছেন যাঁরা তেমন কোন উৎপাদন করেন না কিন্তু বিনিময় করবার জন্য অনেক টাকা হাতে থাকে তাঁদের। মুদ্রাব্যবস্থায় এটা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক বাজার ব্যবস্থায় এটা সম্ভব যে টাকার বিনিময়ে সকল কিছু কেনা যায়। এভাবে বিনিময় এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে বিরাট এক অসমতা আমরা লক্ষ্য করি ।
১৯৬৮ সালে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানী কার্ল পোল্যানয়ি বিভিন্ন সমাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিন ধরনের বণ্টনের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে : পারস্পরিক লেনদেন (reciprocity), পুনর্বণ্টন (redistribution) এবং বাজার বিনিময় (market exchange)। কেউ কেউ এগুলোকে বণ্টনের ধরন না বলে বিনিময়ের ধরন হিসেবে দেখে থাকেন।
এই তিন ধরনের বণ্টনের মধ্যে প্রথম দুটিতে মুদ্রার তেমন কোন ভূমিকা নেই। কিন্তু তৃতীয়টিতে মুদ্রার গুরুত্ব ব্যাপক। বলা চলে যে মুদ্রা ছাড়া বাজার ব্যবস্থা অচল। ইউরোপীয় সমাজে গত কয়েক শ বছর এই ধরনের বণ্টন বা বিনিময় ব্যবস্থা চালু আছে। মুদ্রার সবচেয়ে বড় সামর্থ্য হচ্ছে তা দিয়ে মানুষের শ্রম কেনা যায়। মুদ্রা থাকলে মানে টাকা জমানো থাকলে তার নিজেরই একটা শক্তি থাকে। সেই টাকার পরিমাণ বিনিময় করলে কতটা সম্পদ পাওয়া যাবে সেটারও হিসেব থাকে। অন্য কোন সমাজে ঠিক এইভাবে কোন শক্তি জমিয়ে রাখা যায় না। এরকম নির্বিচারে শ্রমও কেনা যায় না।
বাজার ব্যবস্থার এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্যান্য ব্যবস্থার তুলনায় এখানে মানুষজনকে ঠকাবার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। এর মানে হ’ল: অন্যান্য পদ্ধতির বিনিময়ে দুই বা ততোধিক পক্ষের কারো ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা কম থাকে। সেটাই ঐ পদ্ধতিগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য। কারো কারো মতে বাজার ব্যবস্থার ভিত্তিই হচ্ছে কোন না কোন পক্ষকে ঠকানো বা শোষণ। ইদানিং কালের নৃবিজ্ঞানে বাজার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে।
বিনিময় এবং বণ্টন অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় বিনিময় এবং বণ্টন অধ্যায়ের সারাংশ – যা বিনিময় এবং বণ্টন এর অর্ন্তভুক্ত, অনেক নৃবিজ্ঞানীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সংক্রান্ত ভাবনা এসেছে অর্থশাস্ত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ, ধারণা কিংবা তত্ত্ব থেকে। উৎপাদনের পাশাপাশি বণ্টন এবং বিনিময়কেও ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁরা।
বণ্টন এবং বিনিময় উভয়ক্ষেত্রেই মূল বিবেচ্য হচ্ছে কিভাবে মানুষজন উৎপন্ন দ্রব্য বা সেবা পেতে পারেন। এই দুই-কে একত্রে আলোচনা করা হয়ে থাকে। নৃবিজ্ঞানীদের অনেকেই মনে করেছেন, পুঁজিবাদী নয় এমন সমাজের মানুষজনের মধ্যে বণ্টনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বৈষম্য কম।
বণ্টন এবং বিনিময়ের তিনটা ধরনকে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা: পারস্পরিক লেনদেন, পুনর্বণ্টন এবং বাজার। এর মধ্যে শেষেরটা পরিপূর্ণভাবে পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য। তবে অন্য অনেক নৃবিজ্ঞানী মনে করেছেন, যদি বিনিময় এবং কটন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা হয় তাহলে অবশ্যই মনোযোগ দেয়া দরকার গরিব এবং ধনী দেশগুলোর সম্পর্কের দিকে এবং গরিব এবং ধনী শ্রেণীর সম্পর্কের দিকে।
আরও দেখুনঃ