Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

সর্বপ্রাণবাদ, মহাপ্রাণবাদ ও মানা

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় সর্বপ্রাণবাদ, মহাপ্রাণবাদ ও মানা। সর্বপ্রাণবাদ হচ্ছে মানব-বিহীন সত্ত্বাগুলোতে আধ্যাত্মিক নির্যাস বিরাজিত থাকা। অন্য অর্থে, প্রকৃতির সব কিছুকেই সপ্রাণ মনে করা, সব ক্রিয়াকলাপের পেছনে প্রাণের অস্তিত্বকে অনুভব করাই হলও সর্বপ্রাণবাদ। আর মহাপ্রাণবাদে ব্যক্তিসত্তাহীন এমন একটি শক্তিতে বিশ্বাস যেটি সকল জীবন্ত ও জড় পদার্থে বিদ্যমান এবং যার উপস্থিতিতে কেউ অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়। সর্বপ্রাণবাদ ও মহাপ্রাণবাদ দুটোই ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রাচীন বিশ্বাস ও রীতি-নীতিকে প্রকাশ করে। দুটো তত্ত্বের মাঝেই রীতিগত জায়গায় কিছুটা মিল লক্ষণীয়। আসুন আজ বিস্তারিত আলাপ করি।

সর্বপ্রাণবাদ, মহাপ্রাণবাদ ও মানা

 

 

ভূমিকা

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, উনিশ শতকের বিবর্তনবাদী নৃবিজ্ঞানীরা ধর্মের আদিরূপ ও উৎপত্তি সম্পর্কে বেশ কিছু তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন। এই অধ্যায়ে আমরা এ ধরনের কিছু ধারণা ও তত্ত্বের সাথে পরিচিত হব। বিবর্তনবাদীদের দৃষ্টিতে তথাকথিত ‘আদিম’ সমাজসমূহের অবস্থান ছিল বিবর্তনের নিম্নতর ধাপসমূহে, ফলে সে হিসাবে চিহ্নিত সমাজসমূহের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারের প্রতি তাদের নজর বেশী মাত্রায় কেন্দ্রীভূত ছিল।

ধর্মের উৎপত্তি, আদিরূপ বা ক্রমবিকাশ সম্পর্কে বিবর্তনবাদীদের প্রণীত বিভিন্ন তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা পরবর্তীতে আর ব্যাপকভাবে অনুসৃত না হলেও তাদের ব্যবহৃত কিছু মৌলিক প্রত্যয় এখনো নৃবিজ্ঞানে চালু রয়েছে। এরকমই দুটি প্রত্যয় হল ‘সর্বপ্রাণবাদ’ (animism) ও ‘মহাপ্রাণবাদ’ (animatism)। নীচে এগুলির উপর আলোচনা করা হল।

 

সর্বপ্রাণবাদ

ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী ই. বি. টায়লর (সংস্কৃতির একটি ধ্রুপদী সংজ্ঞার প্রণেতা হিসাবে যাঁর নাম আগেই উল্লেখিত হয়েছে) সর্বপ্রাণবাদের ধারণা নিয়ে আসেন। ইংরেজী animism শব্দটি এসেছে ল্যাটিন animus থেকে, যার অর্থ আত্মা (সে হিসাবে animism-এর বাংলা ‘আত্মাবাদ’ বা সে জাতীয় কিছু করা যেত, তবে এখানে পূর্বপ্রণীত পারিভাষিক প্রতিশব্দ ‘সর্বপ্রাণবাদ’ অনুসৃত হচ্ছে)। টায়লরের মতে সকল সংস্কৃতিতেই আত্মা বা আত্মা-সদৃশ অন্যান্য সত্তার ধারণা কোন না কোন আকারে দেখা যায়।

এর ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্ত উপনীত হন যে, সকল ধর্মের মূলে রয়েছে এই বিশ্বজনীন সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ, অর্থাৎ আত্মার ধারণায় বিশ্বাস, যাকে তিনি animism হিসাবে অভিহিত করেন। টায়লর ধর্মের একটি সরল সংজ্ঞাও দিয়েছেন, তাঁর মতে ধর্ম হল ‘বিভিন্ন আত্মা-রূপীয় সত্তায় বিশ্বাস’ (belief in spirit beings)। আত্ম-রূপীয় সত্তা বলতে টায়লর আত্মা তথা বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত, অশরীরী সত্তা যেমন ভূত- প্রেত, দেব-দেবী, ইশ্বর প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন।

টায়লরের মতে আত্মার ধারণা ছিল আদিম মানুষদের একটি উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন, ধর্মের বিবর্তনের প্রথম ও প্রধান সোপান। তিনি তাঁর Primitive Culture গ্রন্থে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, আত্মার ধারণার সম্প্রসারিত রূপ হিসাবেই বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ভূত-প্রেত দেব-দেবী প্রভৃতির ধারণা ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের উৎপত্তি ঘটেছে।

টায়লর যুক্তি দেখান যে, স্বপ্ন, মৃত্যু, মুর্ছা যাওয়া ইত্যাদির মত কিছু সাধারণ ও সার্বজনীন মানবিক অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়েই নিশ্চয় আদিম মানুষেরা আত্মার ধারণা উদ্ভাবন করে। মানুষ মাত্রেরই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতা হয়। স্বপ্নে মানুষ যেসব অভিজ্ঞতা লাভ করে, সেগুলোর সবকিছু জাগ্রত অবস্থার দৈনন্দিন ঘটনার সাথে মেলে না। মানুষ স্বপ্নে যেন ভিন্ন একটা জগতে বিচরণ করে। স্বপ্নে অনায়াসে দূরবর্তী কোন স্থানে ঘুরে আসা যায়, আকাশে উড়ে বেড়ানো যায়, এমনকি মৃত ব্যক্তিদেরও সাক্ষাত মেলে।

তার মানে প্রত্যেক মানুষের দেহের ভেতরেই নিশ্চয় এমন একটি দ্বিতীয় সত্তা বাস করে, যা আমরা ঘুমিয়ে থাকলে রক্তমাংসের দেহের বাইরে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে। মুর্ছা যাওয়া হল সাময়িকভাবে এই সত্তার দেহত্যাগ, আর মৃত্যুর বেলায় তা ঘটে চিরতরে। এমন অনেক ‘আছরের’ ঘটনাও ঘটে যখন একজন ব্যক্তি হঠাৎ ভিন্ন কারো মত আচরণ করতে থাকে, যেনবা তার মধ্যে অন্য কারো অশরীরী উপস্থিতি রয়েছে। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের একটা বিশেষ পর্যায়ে এভাবেই স্বপ্ন, মৃত্যু প্রভৃতি বিষয়ের ব্যাখ্যা খোঁজার প্রয়াসে ‘আত্মা’র ধারণার আবির্ভাব ঘটে বলে টাইলর মনে করেন।

টায়লরের তত্ত্ব অনুযায়ী আত্মার ধারণার ভিত্তিতে ধর্মের একটি প্রাথমিক রূপ হিসাবে ‘পূর্বপুরুষ পূজা’র (ancestor worship) আবির্ভাব ঘটে, যেখানে গোষ্ঠী-ভিত্তিক সমাজের সদস্যরা নিজ নিজ গোষ্ঠীর মৃত পূর্বসূরীদের আত্মাসমূহের সন্তুষ্টি বিধান ও সহায়তা লাভের লক্ষ্যে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করে। আবার বিবর্তনের পরবর্তী পর্যায়ে এই ধারণার বিকাশ ঘটে যে, শুধু মানুষেরই আত্মা নেই, অন্যান্য প্রাণীরও আত্মা রয়েছে, এমনকি জড়বস্তুর ভেতরেও আত্ম-রূপীয় সত্তা থাকতে পারে।

এ ধরনের বিশ্বাসের ভিত্তিতে এক পর্যায়ে গড়ে ওঠে ‘প্রকৃতি পূজা’ (nature worship), যে ব্যবস্থায় চারপাশের জীবজন্তু, গাছপলা প্রভৃতি মানুষের কাছে আরাধ্য হয়ে ওঠে (‘প্রকৃতি পূজা’ কথাটা কিছুটা বিভ্রান্তিকর, কারণ এটি দিয়ে যে ধরনের বিশ্বাসকে বোঝানো হচ্ছে সেগুলোতে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে নিহিত বলে কল্পিত অতিপ্রাকৃত সত্তাসমূহই আসলে মানুষের কাছে ভীতি, ভক্তি বা পূজার বিষয়)।

টায়লরের মতে ‘প্রকৃতি পূজা’র আরো অগ্রসর ধাপে এসে মানুষ আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, বৃষ্টি, অগ্নি প্রভৃতি প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের মধ্যে বিভিন্ন দেব-দেবীর সন্ধান পায়। এভাবে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার বিকাশের সাথে সাথে বিশ্বজগতকে জানার-বোঝার নিরন্তর প্রয়াসের ফলশ্রুতি হিসাবে বহুইশ্বরবাদের (polytheism) পরবর্তী পর্যায়ে একেশ্বরবাদ (monotheism) এসেছে বলে টায়লর মনে করেন।

একেশ্বরবাদী ধর্মীয় বিশ্বাসে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একক, অদ্বিতীয় ইশ্বরের ধারণা লক্ষ্য করা যায়। তবে একেশ্বরবাদী বিশ্বাসেও আত্মার ধারণা তথা ফেরেশতার মত গৌণ অতিপ্রাকৃত সত্তার স্থান রয়েছে। সে হিসাবে ‘সর্বপ্রাণবাদ’ অতীতে ফেলে আসা কোন স্তর নয়, বরং সকল সমকালীন ধর্মেই মিশে আছে।

টায়লরের তত্ত্বের প্রধান সমালোচনা হচ্ছে এই যে, শুধুমাত্র জীবন ও জগত সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে, একথা মনে করার কোন কারণ নেই। ধর্ম মানুষের অন্যান্য চাহিদাও মেটায়। এছাড়া তথাকথিত আদিম সমাজসমহের মধ্যেও ‘সর্বশক্তিমান ইশ্বর’-এর ধারণা বিরল নয়। সেদিক থেকে বিভিন্ন সমাজকে ধর্মীয় বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপে ফেলার প্রয়াস প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে পড়ে। তবে টায়লরের সকল অনুমান যদি ঠিক নাও হয়, তাঁর বিশ্লেষণের পুরোটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না।

বিবর্তনবাদবিরোধী নৃবিজ্ঞানীরাও একটি মৌলিক প্রত্যয় হিসাবে সর্বপ্রাণবাদের ধারণা ব্যবহার করেন, যা ধর্মের নৃবিজ্ঞানে টায়লরের অবদানের স্বীকৃতি। আবার সর্বপ্রাণবাদ যে বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের একমাত্র বা প্রধানতম ভিত্তি, একথাও বলা যায় না। এক্ষেত্রে ভিন্ন একটি মৌলিক প্রত্যয় হিসাবে ‘মহাপ্রাণবাদে’র ধারণার প্রতি এবার আমরা নজর দেব।

 

মহাপ্রাণবাদ ও মানা

ধর্মের উৎপত্তি ও মৌলিক রূপ সম্পর্কে টায়লর প্রদত্ত ব্যাখ্যার বিকল্প অনুসন্ধান করতে গিয়ে রবার্ট ম্যারেট নিয়ে আসেন animatism-এর ধারণা, যার বাংলা করা হয়েছে ‘মহাপ্রাণবাদ’। ধর্ম হচ্ছে আত্মা-রূপীয় বিভিন্ন সত্তায় বিশ্বাস, টায়লরের এই সংজ্ঞাকে ম্যারেট অতি সংকীর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

অনেক ধর্মেই এমন কিছু শক্তি বা ক্ষমতার ব্যাপারে বিশ্বাস দেখা যায় যেগুলিকে সরাসরি কোন অতিপ্রাকৃত সত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেখা হয় না। বিভিন্ন কিছুর মধ্যে এ ধরনের বিশেষ শক্তির উপস্থিতি বা প্রভাব সংক্রান্ত বিশ্বাসকে ‘সর্বপ্রাণবাদ’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মেলানেশীয় ও পলিনেশীয় সমাজসমূহে এক ধরনের অতিপ্রাকৃত শক্তি বা ক্ষমতার ব্যাপারে ব্যাপক বিশ্বাস দেখা যায়।

এই শক্তিকে একাধিক মেলানেশীয় ভাষায় ‘মানা” (mana) বলা হয়, যে শব্দটা নৃবিজ্ঞানীরা অনুরূপ সকল ধারণাকে সাধারণভাবে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করে (দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের কৃষ্ণকায় আদিবাসী-অধ্যুষিত বেশ কিছু দ্বীপপুঞ্জকে একত্রে মেলানেশিয়া বলা হয়, যার অন্তর্গত রয়েছে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি প্রভৃতি। অন্যদিকে হাওয়াইসহ প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য আরো কিছু দ্বীপপুঞ্জকে একত্রে পলিনেশিয়া বলা হয়)।

‘মানা’ বলতে এমন একটা বিশেষ শক্তি বা গুণকে বোঝায় যা বিভিন্ন বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মেলানেশীয় ও পলিনেশীয় বিশ্বাস অনুসারে এই গুণের অধিকারী ব্যক্তি বা বস্তুর বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। যেমন, কোন ব্যক্তি হয়ত মাছ ধরার কাজে সবসময় বা প্রায়ই বিশেষ সাফল্য অর্জন করে। সেক্ষেত্রে বলা হয় যে, সে অন্যদের চেয়ে বেশী ‘মানা’র অধিকারী। অথবা, কোন জমিতে খুব ভাল ফসল হওয়ার কারণ হিসাবে হয়ত ‘মানা’-গুণ সম্পন্ন বিশেষ কোন বস্তু, যেমন অসাধারণ আকৃতির কোন পাথরের উপস্থিতিকে বিবেচনা করা হয়।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

‘মানা’র পেছনে কোন দৈবসত্তা বা ইশ্বররূপী কারো হাত রয়েছে, এমনটা ভাবা হয় না। বিশেষ বিশেষ উপায়ে, নির্দিষ্ট কিছু জাদুধর্মী আচার-পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে, ‘মানা’ অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করা হয়। ম্যারেট মনে করেন যে, আত্মা, ভূত-প্রেত, দেব-দেবী প্রভৃতি ধারণার আবির্ভাবের আগেই ‘মানা’ জাতীয় শক্তির উপস্থিতি ও ক্রিয়াশীলতা সম্পর্কে বিশ্বাস জন্মেছিল। এ ধরনের বিশ্বাসের পেছনে বিশেষ কোন যুক্তি কাজ করে না, যতটা যুক্তি হয়ত আত্মা বা ভূত-প্রেত সংক্রান্ত বিশ্বাসের বেলায় দেখা যায়।

‘একেশ্বরবাদ” যদি হয় ধর্মীয় বিশ্বাসের সবচাইতে বিবর্তিত ও যুক্তিসিদ্ধ রূপ, তাহলে ‘মহাপ্রাণবাদ’ হবে এর আদিমতম রূপ, অন্ততঃ ম্যারেটের মতে। অবশ্য সর্বপ্রাণবাদী বিশ্বাস শুধুমাত্র তথাকথিত আদিম মানুষদের মধ্যেই সীমিত নয়। একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, ‘মানা’র মত ধারণা আমাদের কাছেও একেবারে অপরিচিত নয়। যেমন, বিশেষ কোন ব্যাট হাতে বা বিশেষ কোন জার্সি গায়ে খেললে ভাল রান তোলা বা বেশী উইকেট পাওয়া সম্ভব, এ কথা যদি কোন ক্রিকেটার বিশ্বাস করে – বাস্তবে যে ধরনের অনেক উদাহরণ আমরা দেখি – তা হবে অনেকটা ‘মানা” সম্পর্কে – মেলানেশীয় বিশ্বাসের অনুরূপ।

 

সর্বপ্রাণবাদ ও মহাপ্রাণবাদ ধারণার মূল্যায়ন

টায়লর ও ম্যারেট উভয়েই বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত বিশ্বাসসমূহ পর্যালোচনা করে কিছু সাধারণীকরণের ভিত্তিতে যথাক্রমে ‘সর্বপ্রাণবাদ’ ও ‘মহাপ্রাণবাদ’কে ধর্মীয় বিশ্বাসের আদি ভিত্তি হিসাবে সনাক্ত করেছেন। তাদের উভয়ের ব্যাখ্যা অনেকটা অনুমান নির্ভর।

ঠিক কেন, কিভাবে সুদূর অতীতে মানুষের মনে ‘মানা’ জাতীয় শক্তি বা আত্মা, ভূত-প্রেত ইত্যাদি সত্ত্বা সম্পর্কে বিশ্বাস জন্মাল, তা নিশ্চিত করে বলা প্রায় অসম্ভব। অবশ্য উপরের আলোচনাতেই আমরা দেখেছি যে, ‘সর্বপ্রাণবাদ’ বা ‘মহাপ্রাণবাদ’ প্রত্যয় শুধুমাত্র তথাকথিত আদিম সমাজ সমূহের ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বরং এগুলি সমকালীন প্রেক্ষিতেও প্রযোজ্য। সে হিসাবে এ ধরনের প্রত্যয়ের বিশ্লেষণী মূল্য রয়েছে।

তবে টায়লর ও ম্যারেট উভয়ের বিশ্লেষণে যে বিষয়টা তেমন বিবেচনায় নেওয়া হয় নি, তা হল, ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সমাজ কাঠামোর সম্পর্ক। কোন বিশ্বাসকে আমরা ‘সর্বপ্রাণবাদ’ বা ‘মহাপ্রাণবাদ’ ধারণার আলোকে কিছুটা বুঝতে সক্ষম হতে পারি, কিন্তু সেটাকে বিশদভাবে জানতে-বুঝতে গেলে সংশ্লিষ্ট সামাজিক ও অন্যান্য প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া জরুরী।

যেমন, ‘মানা’ সংক্রান্ত বিশ্বাস মেলানেশিয়া ও পলিনেশিয়া, উভয় অঞ্চলে সাধারণভাবে দেখা যায়, তবে অঞ্চলেভেদে এই বিশ্বাসের সুনির্দিষ্ট রূপের মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে। সাধারণভাবে মেলানেশীয়দের তুলনায় পলিনেশীয় সমাজ ব্যবস্থা অধিকতর স্তরায়িত ছিল। মেলানেশীয় সমাজে একজন ব্যক্তি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সমাজে মর্যাদার আসন লাভ করতে পারত, এবং সেখানে এমন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, যে কেউ চেষ্টা করে বা ভাগ্যক্রমে ‘মানা’ শক্তির অধিকারী হতে পারে।

 

তুলনামূলক টেবিল: সর্বপ্রাণবাদ বনাম মহাপ্রাণবাদ

বিষয় সর্বপ্রাণবাদ (Panpsychism) মহাপ্রাণবাদ (Vitalism)
মূল ধারণা চেতনা বা অনুভব করার ক্ষমতা সব কিছুর মধ্যেই আছে জীবন্ত সত্তার মধ্যে একটি অতিরিক্ত জীবনীশক্তি রয়েছে
চেতনার অবস্থান চেতনা সার্বজনীন ও মৌলিক চেতনা বা প্রাণশক্তি কেবল জীবন্ত জীবের মধ্যেই
বস্তু জগতে প্রযোজ্যতা জড় পদার্থেও চেতনা বা অনুভব থাকার সম্ভাবনা জড় পদার্থে প্রাণশক্তি নেই
আধুনিক বিজ্ঞানসম্মততা কিছু আধুনিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে পুনঃআলোচনার বিষয় আধুনিক জীববিজ্ঞানে অপ্রচলিত ও বাতিলপ্রায়
ধর্মীয়/আধ্যাত্মিক প্রভাব হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্মে সাদৃশ্য রয়েছে আয়ুর্বেদ, প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসা ও ইউরোপীয় রোমান্টিক ভাবধারায় প্রভাব রয়েছে
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ব্যবহার পদার্থবিদ্যা ও নিউরোসায়েন্সে চেতনার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় মাঝে মাঝে ব্যবহৃত জীববিদ্যায় প্রাণঘটিত প্রক্রিয়া বোঝাতে অতিপ্রাকৃত শক্তির ধারণা দেওয়া হত

 

তুলনামূলক টেবিল: সর্বপ্রাণবাদ, মহাপ্রাণবাদ ও মানা

দিক/বিষয় সর্বপ্রাণবাদ (Animism) মহাপ্রাণবাদ (Vitalism) মানা (Mana)
উৎস আদিম ধর্ম ও লোকজ সংস্কৃতি পাশ্চাত্য দার্শনিক চিন্তা, মূলত 17-19 শতক মেলানেশিয়া, পলিনেশিয়া
মূল ধারণা সব কিছুর মধ্যেই প্রাণ বা আত্মা আছে জীবনের জন্য অতিরিক্ত এক “প্রাণশক্তি” দরকার এক বিশেষ, অতিপ্রাকৃত শক্তি যা ক্ষমতা বা প্রভাব দেয়
ধর্মীয় প্রভাব বহু দেবতা ও প্রকৃতি পূজার ভিত্তি আধ্যাত্মিকতায় গুরুত্ব, তবে ধর্মীয় কাঠামোতে কম ব্যবহৃত ধর্ম, জাদু ও আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত
আধুনিক বৈজ্ঞানিক অবস্থান নৃবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ, বিশ্বাস হিসাবে স্বীকৃত আধুনিক জীববিজ্ঞানে পরিত্যক্ত নৃবিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বে প্রতীকী ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের বিষয়
ব্যবহার লোকাচার, প্রকৃতি উপাসনা জীবতত্ত্ব, জীবন ব্যাখ্যার প্রাচীন প্রচেষ্টা পুরোহিত, শামান, রাজা, বিশেষ ব্যক্তি বা বস্তুতে ধারণ

 

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version