আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মিশরীয় জ্যোতির্বিদ্যা
মিশরীয় জ্যোতির্বিদ্যা
মিশরীয় জ্যোতির্বিদ্যা
মিশরীয়রা অবশ্য বিশুদ্ধ বিজ্ঞানী ছিল না। বিশ্বজগতের প্রকৃত চিত্র জানার জন্যে তারা কখনও চেষ্টা করেনি। তাই জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রেও তারা খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। তবে তারা ‘সৌর-পঞ্জিকার’ আবিষ্কার ও ক্রমে তার উন্নতি সাধন করেছিল। আগেই বলা হয়েছে যে, লুব্ধক নক্ষত্রের আবির্ভাবকাল পর্যবেক্ষণ করে প্রাক্-রাজবংশ কালের মিশরীয়রা ৩৬৫ দিনে বছর গণনার রীতি প্রবর্তন করে। তার আগে মিশরীয়রা চান্দ্রমাসের ভিত্তিতে বছরের হিসাব রাখত।
কিন্তু চান্দ্রমাসের হিসাব যে ত্রুটিপূর্ণ, তা’ তারা বুঝতে পারে নীল নদের বন্যার তারিখ মেলাতে গিয়ে। কারণ, বছরের একটা নির্দিষ্ট দিনে হত; কিন্তু চান্দ্রমাসে বছর পুরো হয় না। তবে ৩৬৫ দিনের বছরের হিসাবেও একটু ভুল রয়ে গিয়েছিল। প্রকৃত সৌরবছরের দৈর্ঘ্য ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ৯ মিনিট ৯.৫ সেকেণ্ড অর্থাৎ মিশরীয় বছর প্রকৃত বছরের চেয়ে প্রায় সিকি দিন দিন) কম। প্রতি বছরে দিন কম ধরলে প্রতি চার বছরে এক দিন বা ১৪৬১ 8 8 (=৩৬৫ × ৪) বছর পরে পুরো একটি বছরের পার্থক্য হয়।
অর্থাৎ নতুন বছরের প্রথম দিন একবার লুব্ধক নক্ষত্র দেখা দেবার পর লুব্ধক নক্ষত্রের আবির্ভাবের সময় প্রতি বছর একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ১৪৬১ বছর পার হলে আবার ঠিক বছরের আরম্ভের দিন দেখা দেয়। প্রতি ১৪৬১ বছর পরপর এটা ঘটতে থাকে।
অবশ্য এ অসঙ্গতি দূর করার জন্যে মিশরীয়রা এত দীর্ঘকাল অপেক্ষা করত না, প্রতি চার বছর অন্তর ৩৬৫ দিনের পরিবর্তে ৩৬৬ দিনে বছর গণনা করে তারা নীলনদের বন্যার সাথে, অর্থাৎ ঋতুর সাথে বছরের হিসাবের সামঞ্জস্য রক্ষা করত। এ অর্থে বলতে গেলে আমরা যাকে ‘লিপ-ইয়ার’ বলি তা’ মিশরীয়দেরই আবিষ্কার। মিশরীয়রা বিভিন্ন স্থির নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করতে পেরেছিল, বিভিন্ন নক্ষত্রমণ্ডল সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেছিল, নক্ষত্র-মানচিত্র রচনায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিল।
ধ্রুব নক্ষত্রের নিকটবর্তী নক্ষত্রদের তারা বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করে। ধ্রুব নক্ষত্রের সাহায্যে দিকনির্ণয় করে তারা পূর্বমুখী মন্দির বা পিরামিড ইত্যাদি নির্মাণ করত। মিশরীয়রা নক্ষত্রের গতি পর্যবেক্ষণের জন্যে একটা সরল ধরনের সুন্দর যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিল। একটা খেজুর পাতার মাঝখানে খানিকটা অংশ লম্বালম্বিভাবে কেটে তার ফাঁক বরাবর একটা ওলনদড়ি বা লম্বসূত্র ঝুলিয়ে দেয়া হত এবং একটা নক্ষত্র যখন সূতোটিকে অতিক্রম করত তখন সে ক্ষণটিকে লিপিবদ্ধ করা হত।
মিশরীয়রা সূর্যের আলোর ছায়া মেপে দিনের সময় নিরূপণের যন্ত্রও আবিষ্কার করেছিল। এটাকে বলা চলে ছায়াঘড়ি বা সূর্যঘড়ি। মিশরের সূর্যঘড়ি অবশ্য অনেক আগের আবিষ্কার; তবে সত্যিকার যে একটা পাথরের নির্মিত ছায়াঘড়ি পাওয়া গেছে, তা ১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ের। প্রায় এক ফুট লম্বা একটি পাথরের পাতের এক প্রান্তে খাড়া আরেকটা দণ্ড বা পাত সংযুক্ত আছে।
নিচের ফলকটির গায়ে একটু পরপর দাগ কাটা আছে, খাড়া পাতটির ছায়া দাগ কোন বরাবর পড়লে কত সময় হয় তা জানা আছে। সকালে যন্ত্রটিকে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি করে বিছিয়ে দেয়া হয়, খাড়া অংশটি থাকে পূর্ব প্রান্তে; দুপুরের পর যন্ত্রটিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় পূর্বমুখী করে যাতে পশ্চিমের সূর্যের ছায়া পড়তে পারে। এর কিছুকাল পরে আরেকটু উন্নত ধরনের ছায়াঘড়ি আবিষ্কৃত হয়।
এটি কাঠের নির্মিত এবং এতে খাড়া দণ্ডটি থাকে যন্ত্রের মাঝখানে, আর নিচের তক্তাটি থাকে দু’পাশে বিস্তৃত হয়ে। এটিকে তাই আর দুপুরের পর ঘুরিয়ে দিতে হয় না, পূর্বাহ্ণে ছায়া পড়ে পশ্চিমের অংশে, অপরাহ্ণে ছায়া পড়ে পূর্বের অংশে। এ যন্ত্রটি এখনো সময় মাপার কাজে মিশরে ব্যবহৃত হয়। ছায়াঘড়ি রাতে অচল, তাই মিশরীয়রা সময় মাপার অন্য যন্ত্রও আবিষ্কার করেছিল। এটা হল পানিঘড়ি বা জলঘড়ি— গ্রীকরা যার নাম দিয়েছিল ‘কেপসিড্রা।’
গ্রীক ভাষায় কেপসিড্রা মানে হল, ‘পানি অপহারক’; পানি চুরি করে বলেই যন্ত্রটির এ নাম। কর্ণাকের মন্দিরে একটি পানিঘড়ি পাওয়া গেছে, এটি প্রায় ১৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে নির্মিত। এ ঘড়িটি আসলে একটি পাত্র, যার তলায় একটি ফুটো আছে। ফুটো দিয়ে অল্প অল্প করে পানি বের হয়ে যায় এবং পাত্রে পানির উচ্চতা ক্রমশ কমতে থাকে। পাত্রের ভিতর দিককার গায়ে দাগ কাটা আছে। পানির উপরিভাগ কোন দাগের কাছে কাছে সেটা দেখে বোঝা যায় কতক্ষণ সময় পার হয়েছে।
ভর্তি পাত্রে পানির উচ্চতা বেশি বলে পানি তাড়াতাড়ি বের হয় এবং আধা-খালি পাত্র থেকে পানি আস্তে আস্তে বের হয়। ফুটো দিয়ে পানি নির্গত হবার বেগ যাতে সমান হয় এ উদ্দেশ্যে তাই পাত্রটির নিচের দিকের চেয়ে ওপরের দিককে চওড়া করা হয়েছে। এর ফলে পানির উচ্চতা সমান হারে কমতে থাকে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে যে, প্রাচীন কালে আরেক রকম সময় নিরূপক যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল।
একটা পানিভর্তি পাত্রে একটা ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট বাটি বসিয়ে দিলে ক্রমশ সেটি পানি ভর্তি হয়ে ডুবে যাবে। বাটি পানি ভর্তি হয়ে ডুবতে কত সময় লাগে জানা থাকলে সহজেই সময় মাপা যায়। আলজিরিয়াতে খেতে পানি দেবার সময়ের পরিমাপ নিরূপণের জন্যে এখনো এ রকম যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশেও কিছু কাল আগে পর্যন্ত পানিতে ছিদ্রবিশিষ্ট ঘটি বসিয়ে অনুরূপ পদ্ধতিতে সময় মাপা হত।
আরও দেখুন :