আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ
মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ
মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ
প্রাচীন মিশরে হায়ারোগ্লিফ লিপির প্রচলন ছিল একথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। খ্রিঃ পূঃ চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষভাগে এর প্রচলনের প্রমাণ পাওয়া গেছে; কিন্তু কত আগে এর প্রথম উদ্ভব বা প্রচলন ঘটেছিল তা এখনও জানা যায়নি। হায়ারোগ্লিফ্ যে চিত্রলিপি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, হায়ারোগ্লিফ লিপির দিকে তাকালে সে বিষয়ে আর সন্দেহ থাকে না। অবশ্য এটাও ধ্বনিলিপি (Phonetic script) ছিল, যদিও তা ছিল অক্ষর ভিত্তিক (Syllable) ধ্বনিলিপি।
হায়ারোগ্লিফ্ লিপির অক্ষরচিহ্নগুলোতে পাখি, মানুষ, চাবুক, দোয়াত, কলম প্রভৃতি বাস্তব পদার্থের-চিত্র অপরিবর্তিত আকারেই রয়ে গেছে। অবশ্য এ অক্ষরগুলো ঐ সব পদার্থের প্রতীক নয়, এ অক্ষরগুলো বিভিন্ন ধ্বনির প্রতীক। যেমন, পেঁচার ছবি হচ্ছে ‘ম’ ধ্বনিটির প্রতীক। চিত্রলিপি থেকে উদ্ভূত হলেও হায়ারোগ্লিফ লিপির যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। চিত্রলিপির সাথে ধ্বনি সংযুক্ত হয়ে কালক্রমে ভাব ও ধ্বনিজ্ঞাপক এক রকম মিশ্র প্রতীকের সৃষ্টি হয়।
ক্রমে বিভিন্ন ব্যঞ্জনধ্বনি প্রকাশের জন্যে হায়ারোগ্লিফ লিপিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকের ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম অনুসৃত হয়নি। যেমন, কতগুলো প্রতীক একটিমাত্র ব্যঞ্জনধ্বনিকে (যথা, গ্ ম্ প্রভৃতি) প্রকাশ করত। কতগুলো প্রতীক আবার দুই বা তিনটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমষ্টিকে প্রকাশ করত। হায়ারোগ্লিফ্ লিপিতে একক ব্যঞ্জন ধ্বনিবিশিষ্ট ২৪টি প্রতীক এবং দুই ব্যঞ্জন ধ্বনিবিশিষ্ট ৭৫টি প্রতীকের ব্যবহার দেখা যায়।
প্রতীকের সাহায্যে ব্যঞ্জনধ্বনির রূপায়ণ দেখে অনেকে ধারণা করেছেন যে, এ থেকেই প্রাথমিক বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে। আসলে হায়ারোগ্লিফ্ লিপির একক ব্যঞ্জনধ্বনির প্রতীকগুলিও ছিল শব্দাংশেরই প্রতীক— বর্ণমালা নয়। তা’ ছাড়াও এ লিপিতে একই ব্যঞ্জনধ্বনি বিভিন্ন প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশিত হয়েছে। ফলে হায়ারোগ্লিফ্ লিপিকে বর্ণমালারূপে ব্যবহার করার সুযোগ ছিল না।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বর্ণমালার মূল নীতি বা পদ্ধতিকে উপলব্ধি করাই সম্ভব হয়নি এ যুগে। বর্ণমালা আবিষ্কারের অনুকূল সামাজিক পরিবেশের উদয় ঘটেছিল লৌহযুগে এবং বর্ণমালাভিত্তিক লেখন পদ্ধতির আবিষ্কারও ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ লৌহযুগের প্রাক্কালে। এ বিষয়ে আমরা পরে বিস্তৃত আলোচনা করব । হায়ারোগ্লিফ্ লিপি সাধারণত ডান থেকে বাঁয়ে লেখা হত। অনেক সময় বাঁ থেকে ডানেও লেখা হত।
প্রাচীন মিশরীয় ভাষার উপযোগী এবং তার সাথে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল এ লিপি। মেসোপটেমিয়ার কিউনিফর্ম লিপিকে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার অনেক জাতি গ্রহণ করে তার মাধ্যমে নিজেদের ভাষাকে প্রকাশ করেছিল। কিন্তু হায়ারোগ্লিফ্ লিপি মিশরীয় ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষার বাহন হতে পারেনি। প্রাচীন মিশরে আরো দু’টি লিপির প্রবর্তন ঘটেছিল, তাদের নাম হল হায়ারেটিক ও ডিমোটিক লিপি।
এরা অবশ্য হায়ারোগ্লিফ লিপিরই অপভ্রংশ। রাজকীয় ও ধর্ম সম্বন্ধীয় বিষয়ে এবং মন্দির ও পিরামিডের দেয়ালের লেখার ব্যাপারেই প্রধানত হায়ারোগ্লিফ্ লিপির ব্যবহার নিবদ্ধ ছিল বলে আকৃতিগত শোভা ও সৌন্দর্য বজায় রাখা প্রয়োজন ছিল। এ লিপি তাই সাধারণ কাজের উপযোগী ছিল না। ব্যবসা বাণিজ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনে বাহুল্য বর্জিত ও টানা লেখার উপযোগী হিসেবে প্রথমে হায়ারেটিক ও তারপর ডিমোটিক লিপির উদ্ভব ঘটে।
ডিমোটিক লিপির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে হায়ারেটিক লিপির ব্যবহার ক্রমশ লোপ পায়। ডিমোটিক লিপি মিশরে খ্রিঃ পূঃ সপ্তম শতাব্দী থেকে পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। রসেটা ফলকের কথা বলে আমরা প্রাচীন মিশরের লিপির প্রসঙ্গ শেষ করব। প্রাচীন মিশরীয় লিপির পাঠোদ্ধারের কাজে পাথরের ফলকটির বিশেষ ভূমিকা আছে।
১৭৯৯ সালে ফরাসী সেনানায়ক (পরবর্তীকালে ফরাসী সম্রাট) নেপোলিয়নের মিশর অভিযানের কালে রসেটা দুর্গে এ প্রস্তরখণ্ডটি আবিষ্কৃত হয়। বর্তমানে এটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। রসেটা ফলকটি হল সম্রাট ‘পঞ্চম টলেমী এপি ফানেসের’ সম্মানার্থে
১৯৭-৯৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রচিত পুরোহিতদের একটি ঘোষণাপত্র। ঘোষণাটি গ্রীক ও মিশরীয় দুই ভাষায়ই লেখা— মিশরীয় অংশটি আবার হায়ারোগ্লিফিক ও ডিমোটিক দুই ধরনের লিপিতে লেখা।
এ ফলকটি পাবার ফলেই গ্রীক ও মিশরীয় অংশের মধ্যে তুলনা করে ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক ‘জাঁ ফ্রাঁশোয়া শাপোলিয় (Jean Francois Champollion) সর্বপ্রথম ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে হায়ারোগ্লিফ্ লিপির পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আরও দেখুন :