Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

সক্রেটিসের তত্ত্ব ও পদ্ধতি

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সক্রেটিসের তত্ত্ব ও পদ্ধতি

সক্রেটিসের তত্ত্ব ও পদ্ধতি

 

 

সক্রেটিসের তত্ত্ব ও পদ্ধতি

সক্রেটিস খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯ অব্দে এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন; খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। সক্রেটিস ছিলেন পেরিক্লিসের যুগের দার্শনিক-পণ্ডিত। পেরিক্লিসের যুগে বিজ্ঞানের অবক্ষয় ঘটেছিল, যে রকম অবক্ষয় গ্রীকসভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে আরো কয়েকবার ঘটেছে।

প্রকৃতিবিজ্ঞান ও মহাজাগতিক সমস্যা সম্পর্কে আয়োনীয় এবং অন্যান্য গ্রীক দার্শনিকরা খ্রিস্টপূর্ব ছয়ের শতকের শুরু থেকে যে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন, তার ফলস্বরূপ খ্রিস্টপূর্ব পাঁচের শতকের মাঝামাঝি অনেকগুলো মতবাদের সৃষ্টি হল। কিন্তু এ সকল মতবাদের প্রত্যেকটি কেবল একটা কথাই প্রমাণ করতে পারত যে, অন্য সব মত ছিল ভ্রান্ত।

ইলিয়া (ঋফণট) নগরীর দার্শনিক পারমেনাইডিস (টেরবণভধচন্দ্র মত ঋফণট) তাঁর নিজস্ব পদ্ধতি প্রয়োগ করে আপাতদৃষ্টিতে প্রমাণ করেন যে, বিজ্ঞানের কোনো ভিত্তিই নেই। তিনি বলেন যে, ‘ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা জগৎ সম্পর্কে যে ধারণা করি, বাস্তব জগৎ তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন; ফলে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে লব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জগৎ সম্পর্কে যে সকল ব্যাখ্যা প্রদান করা হয় তা স্ববিরোধী।

পারমেনাইডিসের ছাত্র জেনো (Zeno) আপাতদৃষ্টিতে প্রমাণ করেন যে গণিতের স্বীকার্য বিষয়গুলোও স্ববিরোধী। এ সকল মতের প্রভাবে তখন বিজ্ঞানকে অসম্ভব বা অবাস্তব সাধনা বলে মনে হল। এ কারণে সক্রেটিসের আগের প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতেরা॥ যথা, প্রোটাগোরাস এবং গর্গিয়াস, বিজ্ঞানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং এমন এক পেশায় নিজেদের মনন ও মেধাকে নিয়োজিত করেন যার লক্ষ্য সত্যের অনুসন্ধান নয়, বরং মানবজীবনকে সফল ও সার্থক করে তোলা।

তাঁদের কথা ছিল, ‘সম্ভাবনা দ্বারাই জীবন চালিত হয়’ এবং বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তা আয়ত্ত করা আমাদের সাধ্যের বাইরে হলেও, বাস্তবক্ষেত্রে উপযোগী এবং ফলদায়ক দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করা সম্ভবপর। প্লেটোর লেখা ফিডো (Phaedo) নামক গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী, তরুণ বয়সে সক্রেটিস তাঁর যুগের রীতি অনুযায়ী তৎকালে প্রচলিত পদ্ধতিতে জ্ঞানের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

তিনি উ ৎসাহের সাথে ঐ যুগের ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান’ সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন এবং ঐ সময়ে প্রচলিত সমস্ত দার্শনিক মতবাদ সম্পর্কে শিক্ষালাভ করেন। তিনি বিশেষভাবে সমতলীয় পৃথিবী সম্পর্কিত মাইলেশীয় দার্শনিকদের তত্ত্ব এবং গোলাকার পৃথিবী সম্পর্কিত ইটালির গ্রীক দার্শনিকদের তত্ত্ব অধ্যয়ন করেন। একক দৈর্ঘ্য বা সরলরেখার নিরবচ্ছিন্নতা সম্পর্কে জেনো যে গাণিতিক ধাঁধার উদ্ভাবন করেছিলেন, সক্রেটিস আগ্রহের সাথে সে বিষয়েও পড়াশোনা করেন।

কিন্তু সক্রেটিস দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলেন যে, প্রত্যেক দার্শনিক অন্যান্যদের মতকে খণ্ডন করতে পারলেও কেউই নিজের মতের সত্যতা সম্পর্কে কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে, ঐ সময়ে সমালোচনামূলক বা বিশ্লেষণমূলক কোনো পদ্ধতির অস্তিত্ব ছিল না। প্রকৃতিবিজ্ঞান সম্পর্কে হতাশ হয়ে সক্রেটিস সিদ্ধান্ত করলেন যে, ঘটনা বা তথ্যকে প্রাথমিক সত্যরূপে গণ্য না করে, ঘটনা বা তথ্য সম্পর্কে যে বিবৃতি বা প্রস্তাব প্রদান করা হয় তাকেই প্রাথমিক গুরুত্বসম্পন্ন বলে গণ্য করা প্রয়োজন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তাঁর পদ্ধতি ছিল এরকম কোনো বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে ঐ সম্পর্কে যে কল্পনা বা স্বীকার্যকে (hypothesis, postulate) সবচেয়ে সন্তোষজনক বলে বোধ হয় সেটাকে মেনে নিয়েই আলোচনায় অগ্রসর হওয়া এবং তার থেকে কি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় তা নির্ণয় করা। যদি দেখা যায় যে, এভাবে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত বা ফলাফলকে সত্য এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে বোধ হচ্ছে, তাহলে ঐ কল্পনাকে আপাতত সঠিক বলে গণ্য করা চলবে।

অপরপক্ষে, যদি প্রাথমিক কল্পনা থেকে অগ্রসর হয়ে আমরা ভ্রান্ত বা অসঙ্গতিপূর্ণ বা স্ববিরোধী সিদ্ধান্তে উপনীত হই তাহলে ঐ প্রাথমিক কল্পনাকে পরিত্যাগ করতে হবে। কিন্তু এ পদ্ধতির একটা অকাট্য নিয়ম হচ্ছে প্রাথমিক কল্পনা বা হাইপোথিসিসের বিশ্লেষণের পরিণতিতে যে ফল পাওয়া যায় তাকে ঐ সকল কল্পনার সত্যতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা চলবে না।

যদি কোনো বিষয়ের সত্যতা নির্ণয়ের প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তাহলে তার মীমাংসা হতে পারে শুধুমাত্র তখনই, যদি অন্য একটা সর্বজনগ্রাহ্য কল্পনা থেকে আরম্ভ করে তাকে বিশ্লেষণ করে বর্তমান প্রাথমিক কল্পনায় পৌঁছানো যায়। অর্থাৎ ধরা যাক ‘ক’ নামক কল্পনা থেকে যাত্রা শুরু করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেল যাকে আপাতদৃষ্টিতে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সঠিক বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এর দ্বারাই ‘ক’ কল্পনার সত্যতা প্রমাণিত হবে না।

যদি দুই বিরোধী পক্ষ ‘ক’ কল্পনার যৌক্তিকতা সম্পর্কে একমত না হন, তাহলে ‘ক’-এর বিশ্লেষণের পরিণতিতে সঙ্গতিপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছলেও ‘ক’ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করা চলবে না। এরকম ক্ষেত্রে আরো প্রাথমিক একটা সরল ‘অ’ প্রকল্পকে নিয়ে আরম্ভ করতে হবে যে প্রকল্পের সত্যতা সম্পর্কে দুই বিরোধী পক্ষই একমত। এরপর যদি ‘অ’ থেকে যাত্রা শুরু করে সিদ্ধান্ত- স্বরূপ ‘ক’ প্রকল্পে পৌঁছানো যায়, তখনই শুধু ‘ক’ প্রকল্প থেকে যে সিদ্ধান্ত টানা যায় তাকে সত্য বলে মানা চলবে।

এ পদ্ধতিটি আধুনিক কালেও খাঁটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিরূপে গৃহীত হয়েছে। পণ্ডিতদের মতে দার্শনিক জেনোর আলোচনায় এ পদ্ধতির প্রাথমিক আভাস পাওয়া যায়। (উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্লেটো তাঁর ‘পারমেনাইডিস’ নামক গ্রন্থে বলেছেন যে, সক্রেটিসের যৌবনকালে জেনোর সাথে সক্রেটিসের সাক্ষাৎ হয়েছিল। আবার, এ্যারিস্টটলও জেনোকে ‘ডায়ালেকটিক’ বিচার পদ্ধতির স্রষ্টা বলে উল্লেখ করেছেন)।

 

 

সক্রেটিসের দার্শনিক, নৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক মতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে তরুণদের বিপথগামী করার অভিযোগ আনেন। বিচারে সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।

আরও দেখুন :

Exit mobile version