Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

হিট্টাইট ও ফ্রিজীয় সভ্যতা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হিট্টাইট ও ফ্রিজীয় সভ্যতা

হিট্টাইট ও ফ্রিজীয় সভ্যতা

 

 

হিট্টাইট ও ফ্রিজীয় সভ্যতা

আজ থেকে একশ’ বছর আগে হিট্টাইটদের সম্পর্কে তাদের নাম ছাড়া আর বিশেষ কিছুই জানা ছিল না। কিন্তু ১৮৭০ সালে সিরিয়ার এক অঞ্চলে কিছু প্রস্তরলিপি পাওয়া যায়। আরো অনুসন্ধান চালানোর ফলে ১৯০৭ সালে আনাতোলিয়া অঞ্চলের বোঘজ কুই গ্রামের কাছে এক প্রাচীরঘেরা সুরক্ষিত নগরীর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে প্রায় ২০ হাজার দলিলপত্র, চিঠি, শিলালিপি ইত্যাদি পাওয়া গেছে এবং তাদের অনেকগুলোরই পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছে।

এ সকল সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং দলিলপত্র থেকে জানা গেছে যে, হিট্টাইটরা এককালে এশিয়া মাইনর-এর সমস্ত অঞ্চল জুড়ে তাদের সাম্রাজ্যবিস্তার করেছিল। এমনকি কিছুকাল সিরিয়া এবং ফিনিশিয়া ও প্যালেস্টাইনের অংশবিশেষও হিট্টাইট সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
হিট্টাইট রাজশক্তির উদয় ঘটেছিল প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বব্দের দিকে এবং ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তা’ এক পরাক্রমশালী শক্তি হিসেবে বিরাজ করছিল। এরপর হিট্টাইট সভ্যতা অবশ্য আরো কয়েকশ’ বছর শক্তিহীন অবস্থায় টিকে ছিল।

১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সমকালে সম্রাট ‘লাবারনাশ’ এশিয়া মাইনরের বিস্তৃত অঞ্চলে হিট্টাইট সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তার করেন। লাবারনাশকেই হিট্টাইট রাজশক্তির প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করা হয়। হিট্টাইট রাজবংশের অপর এক বিখ্যাত সম্রাট হচ্ছেন ‘প্রথম মুর্শিলিশ’। এই পরাক্রমশালী সম্রাট ব্যবিলন অধিকার এবং লুন্ঠন করেছিলেন। হিট্টাইট রাজশক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে খ্রিস্টপূর্ব পনেরো শতকে সম্রাট ‘শুপ্পিলুলিউমাশ’-এর আমলে।

এ সম্রাটের নেতৃত্বে হিট্টাইটরা এশিয়া মাইনরের দক্ষিণাংশ এবং টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস-এর উত্তরাংশে অবস্থিত মিতানি রাজ্য অধিকার করে। শুপ্পিলুলিউমাশ-এর উত্তরসুরীগণ মিশরের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইন করায়ত্ত করেন। খ্রিস্টপূর্ব চৌদ্দ-তের শতাব্দীতে মিশর এবং হিট্টাইট শক্তির মধ্যে ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হয় এবং শেষ পর্যন্ত এক সন্ধির মধ্যে দিয়ে লড়াইয়ের অবসান ঘটে।

সন্ধি অনুযায়ী উত্তর সিরিয়া হিট্টাইটদের করায়ত্ত থাকে। কিন্তু এ শক্তিক্ষয়ী যুদ্ধে মিশর এবং হিট্টাইট উভয় রাজশক্তিই দুর্বল হয়ে পড়ে।
১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পর থেকে হিট্টাইট সাম্রাজ্যের শক্তি খর্ব হতে থাকে। এ সময়ে ঈজিয়ান উপসাগর অঞ্চল থেকে দুর্ধর্ষ জাতির মানুষরা এসে এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি অঞ্চল আক্রমণ করতে থাকে এবং এদের হাতেই কালক্রমে হিট্টাইট সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এর পরেও ইউফ্রেটিস নদীর তীরবর্তী ‘কারকেমিশ’ নগরকে কেন্দ্র করে হিট্টাইট সভ্যতা কিছুকাল টিকে ছিল। কিন্তু এ নগর কোনো সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল না, এটা ছিল এক বাণিজ্যকেন্দ্র। অবশেষে ৭১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আসিরিয়ার হাতে অবশিষ্ট হিট্টাইট রাজ্যের পতন ঘটে। হিট্টাইট সভ্যতা যথেষ্ট উচ্চমান অর্জন করেছিল। আধুনিক কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হিট্টাইট সভ্যতা মিশর ও ব্যবিলনের সভ্যতার সমপর্যায়ভুক্ত ছিল।

অবশ্য এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে অন্তত বৈষয়িক উৎকর্ষের দিক থেকে হিট্টাইটরা যে যথেষ্ট উন্নতি করেছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কৃষি বিষয়ে হিট্টাইটরা উন্নত জ্ঞানের অধিকারী ছিল এবং সাধারণভাবে তাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপও যথেষ্ট বিকাশ লাভ করেছিল। হিট্টাইটরা খনি থেকে প্রচুর পরিমাণ রূপা, তামা ও সীসা আহরণ করত এবং প্রতিবেশী জাতিসমূহের কাছে তা’ বিক্রি করত।

বিশ্বসভ্যতায় হিট্টাইটদের একটা প্রধান অবদান হল, এরা লোহা আবিষ্কার করেছিল অর্থাৎ লোহার আকরকে উত্তপ্ত করে লোহা নিষ্কাশনের কৌশল আবিষ্কার করেছিল। হিট্টাইটরা খনি থেকে লোহার আকর সংগ্রহ করত এবং আকর থেকে লোহা নিষ্কাশন করে তার সাহায্যে বিভিন্ন অস্ত্র ও হাতিয়ার নির্মাণ করত। লোহার হাতিয়ার এবং অস্ত্র ব্রোঞ্জের হাতিয়ারের চেয়ে সহজলভ্য ও সস্তা, অথচ অনেক বেশি উপযোগী ছিল।

হিট্টাইটদের কাছ থেকে অবশিষ্ট সভ্যজগৎ ক্রমে ক্রমে লোহা তৈরির পদ্ধতি জানতে পারে। বিশ্বসভ্যতার বিকাশে হিট্টাইটরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হিট্টাইটদের মাধ্যমেই মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন উপাদান হিসস, কানানবাসী প্রভৃতি জাতির মধ্যে এবং সম্ভবত ঈজিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল। এভাবে হিট্টাইটরা ইউরোপে প্রাচীন এশীয় সভ্যতার বিস্তার সাধনে সহায়তা করেছিল।

হিট্টাইটদের কৃষ্টি ও সামাজিক রীতিনীতি ফ্রিজীয় (দেরহথধটভ) নামক অপর এক জাতিকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রাচীনকালে এশিয়া মাইনরের উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যভাগ জুড়ে অবস্থিত ফ্রিজিয়া নামক অঞ্চলে এরা বাস করত। ফ্রিজীয়রা জাতিগতভাবে গ্রীকদের সাথে সম্পর্কিত ছিল বলে অনুমান করা হয়। ফ্রিজীয়রা এককালে সম্ভবত হিট্টাইটদের অধীনে ছিল। তবে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পর ফ্রিজীয়রা স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করতে থাকে।

পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে, ফ্রিজীয়দের বিস্তার লাভের ফলেই হিট্টাইটদের শক্তি অনেকাংশে কমে গিয়েছিল। ৬১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লিডীয়রা ফ্রিজিয়া জয় করে নেয়, কিন্তু ফ্রিজীয়রা তারপর ক্রমশ আংশিক স্বাধীনতা অর্জন করে। এ সময় ফ্রিজীয়দের ভাস্কর্য ও স্থাপত্য-শিল্প বিশেষ বিকাশ লাভ করে।

 

 

অবশেষে ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ফ্রিজীয়দের বাসভূমি সেলুকাসের সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত ৩০০ খ্রিস্টাব্দের পর ‘বাইজেন্টাইন’ সাম্রাজ্যের অধীনে ফ্রিজীয়দের অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয়।ফ্রিজীয়দের মাধ্যমে এশিয়ার অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান গ্রীসীয় ও রোমকদের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল। ফ্রিজীয়দের প্রধান দেবী ‘সিবিলি’-র উপাসনা গ্রীক ও রোমকদের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল।

আরও দেখুন :

Exit mobile version