আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্যাট্রিসিয়ান ও প্লিবিয়ানদের সংগ্রাম
প্যাট্রিসিয়ান ও প্লিবিয়ানদের সংগ্রাম
প্যাট্রিসিয়ান ও প্লিবিয়ানদের সংগ্রাম
রাজতন্ত্রের অবসানের আগেই রোমের জনগণ প্যাট্রিসিয়ান এবং প্লিবিয়ান এ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। প্রাচীনকাল থেকে যেসব পরিবার রোমে বাস করে এসেছিল তারাই নিজেদের প্যাট্রিসিয়ান বলত। এরাই সিনেট সদস্যদের পদ এবং কন্সাল ও সকল গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদ একচেটিয়াভাবে অধিকার করে থাকত।
এ সুবিধাভোগী শ্রেণীর বাইরে যারা ছিল, তাদের বলা হত প্লিবিয়ান। ইটালির বিভিন্ন স্থান থেকে স্বাভাবিকভাবেই অনেক লোক এসে রোমে বসবাস করত। এ ছাড়া রোমকরা অন্যান্য নগররাষ্ট্রসমূহ জয় করে সেখানকার কৃষক কারিগরদের ভূসম্পত্তি দখল করে তাদের রোমে এসে বসবাস করতে বাধ্য করত। এ নবাগতরা এবং তাদের বংশধররাই ক্রমে প্লিবিয়ান বা সাধারণ লোক নামে পরিচিত হয়েছিল।
অধিকাংশ প্লিবিয়ান যদিও দরিদ্র কৃষক ও কারিগরই ছিল, তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ধনী ব্যবসায়ী, জাহাজ-মালিক ইত্যাদিও ছিল।
রোমান সমাজে প্যাট্রিসিয়ান ও প্লিবিয়ানদের অবস্থান ছিল দুটি বিপরীত মেরুতে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্যাট্রিসিয়ানগণ সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা ভোগ করত। তাদের মধ্য থেকে কন্সাল নিযুক্ত করা হত এবং কাউন্সিল অব এল্ডার্স ও সিনেটের সদস্য নিযুক্ত হত তারাই।
ম্যাজিস্ট্রেট, পুরোহিত ও অন্যান্য রাজকীয় বড় বড় পদগুলি তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হত। প্লিবিয়ানগণ শুধুমাত্র সেন্টুরিয়া সভাতে কিছুসংখ্যক আসন গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু যেহেতু সেন্টুরিয়া সভার কাজ ছিল ম্যাজিস্ট্রেট-এর প্রস্তাবগুলিকে সমর্থন করা, কাজেই এক অর্থে এটা প্যাট্রিসিয়ানদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। অর্থনৈতিকভাবেও প্লিবিয়ানগণ ছিল সব দিক দিয়ে বঞ্চিত। অত্যাচারী প্যাট্রিসিয়ান ম্যাজিস্ট্রেটদের শাসনে তাদের জীবন ও সম্পত্তির কোনো নিরাপত্তা ছিল না।
রাষ্ট্রীয় করভার বিপুলভাবে তাদের উপর চাপান হত, অন্যদিকে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করা ছিল তাদের পক্ষে বাধ্যতামূলক। বিচারবিভাগেও প্যাট্রিসিয়ানদের প্রতি ব্যবহার ছিল পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। অন্যদিকে রোমান আইন লিপিবদ্ধ না থাকার দরুন প্লিবিয়ানগণ তাদের অধিকার কতখানি, সে সম্বন্ধেও অবহিত ছিল না; রোমান কন্সালগণ যেভাবে খুশি সে সকল আইনের ব্যাখ্যা করতেন। অনেক ক্ষেত্রে প্লিবিয়ানদের ঋণের দায়ে ক্রীতদাস বানানোর প্রথাও রোমান সমাজে প্রচলিত ছিল।
এ সকল অন্যায়ের প্রতিকারকল্পে প্লিবিয়ানগণ শেষ পর্যন্ত প্যাট্রিসিয়ানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়। প্যাট্রিসিয়ান ও প্লিবিয়ানদের মধ্যে এ সংঘর্ষ প্রায় দু’শ বছর ধরে চলে। ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লিবিয়ানগণ তাদের নিজস্ব ট্রিবিউন নির্বাচিত করার অধিকার অর্জন করে। প্লিবিয়ানদের নিজস্ব প্রতিনিধিদের বলা হত ট্রিবিউন। প্যাট্রিসিয়ান ম্যাজিস্ট্রেটদের অবৈধ কার্যকলাপের উপর ভেটো প্রয়োগ করার ক্ষমতা ট্রিবিউনদের দেয়া হয়।
অধিকন্তু প্রত্যেক ট্রিবিউনের বাড়ির দরজা সর্বক্ষণ প্লিবিয়ানদের আশ্রয় গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। ট্রিবিউনদের নেতৃত্বে প্লিবিয়ানগণ তাদের অন্যান্য অধিকার অর্জনে অগ্রসর হয়। এবার তাদের সংগ্রাম হল জমির জন্য সংগ্রাম। রোমানগণ যখনই কোনো নতুন দেশ জয় করত, তখন সে দেশের কৃষিযোগ্য জমির বিপুল অংশ সরকারি সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত করে নিত। এ সকল দেশ জয়ের পুরো কৃতিত্বই ছিল প্লিবিয়ানদের।
কিন্তু প্যাট্রিসিয়ানগণ, এ সকল কৃষিজমির প্রায় সম্পূর্ণটাই দাবি করতে শুরু করে। স্বভাবতই প্লিবিয়ানগণও তাদের অংশ দাবি করে। কিন্তু জমিসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো নিষ্পত্তি শেষ পর্যন্ত হয়নি। এ * সমস্যার সমাধান না হওয়ার ফলেই শেষ পর্যন্ত রোম প্রজাতন্ত্র তার চরম বিপর্যয় ডেকে ধ্বংসের কবলে পতিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দে প্লিবিয়ানদের আরেক দফা বিজয় সূচীত হয় লিখিত রোমান আইন আদায়ের মাধ্যমে।
বারটি ব্রোঞ্জের পাতের উপর সমগ্র রোমান আইন সঙ্কলিত করা হয়। এ কারণে এর নাম দেয়া হয় বার দফা আইন সঙ্কলন। এতে প্যাট্রিসিয়ান ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক কোনো প্লিবিয়ানের উপর অবৈধভাবে জারিকৃত প্রাণদণ্ডাদেশ-এর বিরুদ্ধে আপীল করার অধিকার দেয়া হয়। কিন্তু ঋণের দায়ে ক্রীতদাস বানানোর প্রথাকে এ আইনের দ্বারা বাতিল করা হয়নি। পরবর্তী ধাপে প্লিবিয়ানদের প্রায় ম্যাজিস্ট্রেটদের সমমর্যাদাসম্পন্ন অধিকার দেয়া হয় এবং ৩৩৩ খৃষ্ট পূর্বাব্দে প্রথম প্লিবিয়ান কন্সাল নিযুক্ত হন।
যেহেতু প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী রোমের কন্সালগণ তাঁদের কার্যকালের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর সিনেটের সদস্য হতে পারতেন, এখন থেকে তাই সিনেটে প্যাট্রিসিয়ানদের একচেটিয়া আধিপত্য বিলুপ্ত হল। প্লিবিয়ানদের সর্বশেষ বিজয় লাভ ঘটে ২৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন হর্তেনসীয় আইনে (রোমের শাসক কুইন্টাস হর্তেনসীয়াস-এর নামানুসারে) ঘোষণা করা হয় যে, গণসভা কর্তৃক জারিকৃত যে কোনো আইন— তা সিনেট অনুমোদন করুক— বা না করুক৷ রাষ্ট্রের উপর বলবৎ হবে।
প্যাট্রিসিয়ানদের বিরুদ্ধে প্লিবিয়ানদের এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল সম্পূর্ণভাবে অহিংস পদ্ধতিতে, সশস্ত্র পদ্ধতিকে পরিহার করে। প্লিবিয়ানগণ তাদের দাবি মানতে বাধ্য করার জন্য দু’বার একত্রে দল বেঁধে শহর পরিত্যাগ করে চলে যায় এবং পাহাড়ের উপর নতুন নগর তৈরী করার ভয় দেখায়। এ পদ্ধতিকে বলা হত সিসেশান। এতে আশানুরূপ ফল পাওয়া গিয়েছিল। প্যাট্রিসিয়ানদের বিরুদ্ধে প্লিবিয়ানদের বিজয়ের ফলে তাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কতকগুলি সুবিধালাভ ঘটে।
রোমান ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা খর্ব করে প্লিবিয়ানদের শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু এটা কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচীত করেনি। রাষ্ট্রযন্ত্র পূবের্কর মতোই স্বৈরাচারী থেকে যায়। শাসনযন্ত্রে প্লিবিয়ানদের অংশগ্রহণের অধিকার জনগণের উপর রাষ্ট্রের স্বৈারাচারী শাসনের এতটুকু অবসান ঘটায়নি।
সিনেটের প্রবল প্রতাপ পূর্বের মতই বহাল থাকে। এতে প্লিবিয়ানদের সদস্য হওয়ার সুযোগ দিলেও, সিনেটের প্রতি রোমের জনগণের অচলাভক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এর ক্ষমতাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রূপে টিকিয়ে রাখে।
আরও দেখুন :