Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

মানুষের ইতিহাসে তাম্রযুগ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মানুষের ইতিহাসে তাম্রযুগ। তাম্রযুগ সেই সময়, যখন মানুষ পাথর দ্বারা শ্রম হাতিয়ার তৈরি করার পরিবর্তে তামা দ্বারা জিনিসপত্র তৈরি করতো। খ্রিস্টাব্দের প্রায় ৪ সহস্রাব্দ পূর্বে বা আনুমানিক প্রায় ৬হাজার বছর পূর্বে এই তাম্র যুগের সূচনা ঘটে।

মানুষের ইতিহাসে তাম্রযুগ

 

 

মানুষের ইতিহাসে তাম্রযুগ

নতুন পাথরের যুগ থেকে ‘ব্রোঞ্জ যুগ’ অর্থাৎ নগরসভ্যতার যুগে উত্তরণের মধ্যবর্তী কালকে তাম্রযুগ বা ‘তাম্ৰোপলীয়’ যুগ (তাম্র প্রস্তর যুগ) ধরা হয়। এ সময়ে মানুষ প্রথম বারের মতো পাথরের বদলে তামার হাতিয়ার ব্যবহার করতে শেখে। এটা ছিল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। নতুন পাথরের যুগের শেষ দিকেই মানুষ আবিষ্কার করে যে, তামার আকরকে কাঠকয়লা পুড়িয়ে উত্তপ্ত করলে তা থেকে তামা পাওয়া যায়। মানুষ অবশ্য তখনও খনি থেকে আকর সংগ্রহ করতে শেখেনি।

তামার সঙ্গে বাতাসের অক্সিজেন যুক্ত হলে এক রকম পাথর তৈরি হয়। এ রকম তামার আকর বা পাথুরে পদার্থ পাহাড় অঞ্চলের কাছাকাছি মাটির উপরেই পাওয়া যায়। এ আকরকে উত্তপ্ত করলে তার থেকে অক্সিজেনটুকু দূর হয়ে যায় এবং খাঁটি তামাটুকু পড়ে থাকে। এ ছাড়া ম্যালাকাইট থেকেও তামা নিষ্কাশন করতে শিখেছিল মানুষ। ম্যালাকাইট হচ্ছে তামা, কার্বন ও অক্সিজেনের সংমিশ্রণে গঠিত সবুজ রং-এর একটা খনিজ পদার্থ বা আকর।

মিশরের এবং অন্যান্য স্থানের মানুষরা প্রাচীনকালে চোখে সুরমা দেবার জন্য এটা ব্যবহার করত। প্রথম প্রথম ধাতুশিল্পী বা কর্মকার তামার পিওকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বিভিন্ন আকারের হাতিয়ার বা যন্ত্র তৈরি করত। ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের আগেই মানুষ তামা ঢালাই করে হাতিয়ার তৈরির কৌশল আবিষ্কার করে। এ পদ্ধতিতে, পাথর খোদাই করে বা মাটি দিয়ে প্রথমে একটা ছাঁচ তৈরি করে তাতে গলন্ত তামা ঢেলে দেয়া হত।

পরে তা’ জমাট বাঁধলে ছাঁচ থেকে তাকে আলাদা করে ঘষে-মেজে হাতিয়ার তৈরি করা হত। ৩০০০ খৃস্ট পূর্বাব্দের দিকে মেসোপটেমিয়াতে ‘সিরে পারডু’ বা ‘মোম গলানো’ পদ্ধতির প্রচলন ঘটে। এটা এক চমকপ্রদ কৌশল। যে রকম আকৃতির হাতিয়ার দরকার প্রথমে সে আকৃতির একটা মোমের আদল তৈরি করা হয়। তারপর মোমের আদরাটিকে চারদিকে কাদামাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়, কেবল দু’দিকে দুটো ফুটো থাকে।

এরপর পুরো জিনিসটিকে আগুনে পোড়ালে মোম গলে বের হয়ে যায় এবং কাদামাটির প্রলেপটি আগুনে পোড়ার ফলে সেটা একটা শূন্যগর্ভ ছাঁচে পরিণত হয়। এখন একটা ফুটো বন্ধ করে অন্য ফুটো দিয়ে গলন্ত তামা বা অন্য ধাতু ঢেলে দিলে সেটা ভেতরে শূন্যস্থানের আকার পায়। তামা শক্ত হয়ে গেলে মাটির ছাঁচটি ভেঙে ফেলা হয় এবং ভেতর থেকে তখন যে শক্ত ধাতব পদার্থটি বের হয়ে আসে সেটার আকৃতি ঠিক মোমের আদরার আকৃতির অনুরূপ।

তামা বা ধাতু আবিষ্কারের ফলে মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেল। তামার হাতিয়ার পাথরের মতো ভঙ্গুর নয়। ভেঙ্গে গেলেও তাকে গলিয়ে আবার নতুন করে হাতিয়ার বানানো চলে, কিন্তু পাথরের হাতিয়ার ভেঙ্গে গেলে তা চিরকালের মতো নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া ছাঁচে ঢেলে তামার হাতিয়ার অল্প সময়ে অনেক বেশি সংখ্যায় তৈরি করা চলত। সবচেয়ে বড় কথা, তামা দিয়ে যে কোনো আকারের হাতিয়ার তৈরি করা চলত, কিন্তু পাথর দিয়ে তা সম্ভব হত না।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বিশেষত, গাছ্ কাটা বা কাঠ চেরাই করা ইত্যাদি কাজ পাথরের হাতিয়ার দিয়ে করা সম্ভবই ছিল না, কিন্তু তামার হাতিয়ার দিয়ে সে কাজ হতে পারত। অবশ্য ব্রোঞ্জ ও লোহা আবিষ্কারের আগে তামা দিয়ে যে গাছ ও কাঠ কাটার কাজ খুব ভালভাবে করা যেত তা নয় । ধাতুর আবিষ্কারের সাথে সাথেই যে পাথরের হাতিয়ারের ব্যবহার মানুষ বর্জন করেছিল এমন নয়। দীর্ঘকাল পর্যন্ত ধাতব হাতিয়ারের পাশাপাশি পাথরের হাতিয়ারের ব্যবহারও প্রচলিত ছিল।

তা ছাড়া দুর্মূল্য তামার হাতিয়ার সকলের আয়ত্তের মধ্যেও ছিল না। এ কারণে মানব ইতিহাসের এ পর্যায়কে ‘তাম্রযুগের’ বদলে ‘তাম্ৰোপলীয়’ (বা তাম্র-প্রস্তর) যুগও বলা হয়। অবশ্য তামার হাতিয়ারই এ যুগের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়।

নতুন পাথরের যুগে ও তাম্বোপলীয় যুগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যথা৷ লাঙল, চাকাওয়ালা গাড়ি, পালওয়ালা নৌকা, কুমারের চাক, লাঙল ও গাড়িতে পশুশক্তির ব্যবহার ইত্যাদির ভিত্তিতে এ যুগে যে সকল উৎপাদন মূলক কাজ হয়েছিল তাই পরবর্তীকালে ব্রোঞ্জযুগের নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার ভিত্তি নির্মাণ করেছিল। তাম্ৰোপলীয় যুগকে তাই বলা চলে নগর সভ্যতার প্রস্তুতির যুগ।

ওপরে যে সব যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের অধিকাংশ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে, এখন কেবল চাকাযুক্ত গাড়ি ও পালতোলা নৌকো সম্পর্কে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হবে। প্রাচীন পাথরের যুগে বা মধ্য পাথরের যুগে মানুষ স্লেজ গাড়ি আবিষ্কার করেছিল, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। বরফের দেশে কুকুর বা বলগা হরিণ এ গাড়ি টানত। তৃণভূমি বা অন্য শুষ্ক ও মরু অঞ্চলে ঘোড়া বা গরুতে টানা স্লেজেরও প্রচলন হয়েছিল।

কালক্রমে, প্রায় ছয় হাজার বছর আগে মানুষ চাকাযুক্ত গাড়ি আবিষ্কার করে। নতুন পাথরের যুগে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে এ আবিষ্কার গভীর ভাবে সম্পর্কিত। পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামবাসীদের মধ্যে নানা প্রকার প্রয়োজনীয় পণ্য ও জিনিসপত্রের বাণিজ্যিক আদান প্রদান হত এ কথা আগেই বলা হয়েছে। স্লেজগাড়িতে খুব ভারি জিনিস বহন করা সম্ভব নয়। প্রথম প্রথম হয়তো ভারি পাথর ইত্যাদি পরিবহণের জন্যে গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করা হত।

পুরাতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার করেছেন যে, প্রাচীনতম মিশরীয়রা কাঠের গোল গুঁড়ির ওপর পাথর ইত্যাদি চাপিয়ে দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেত। অবশ্য গুঁড়ি এক পাক ঘোরার আগেই পাথরের টুকরোর সামনের দিকে নিচে আরেকটা গুঁড়ি স্থাপন করতে হত যাতে পাথরের টুকরোটা উল্টিয়ে পড়ে না যায়। ক্রমশ হয়তো গুড়ির মাঝের অংশ খোঁড়ল করে তাতে পাথর ইত্যাদি ভারি মাল বসানোর চেষ্টা হয়। এর অনুকরণেই হয়তো ক্রমশ দুটো চাকার কেন্দ্রস্থলকে গোলাকার দণ্ড দিয়ে সংযুক্ত করা হত।

প্রথম দিকের চাকাযুক্ত গাড়িতে এ দণ্ডটি চাকার সাথে সাথে ঘুরত। পরবর্তীকালে চাকা দুটোর কেন্দ্রস্থলে ফুটো করে যে দণ্ড প্রবেশ করানো হত সেটি ঘুরত না, কেবল চাকাগুলোই ঘুরত— আজকালকার গরুর গাড়ির মতো।

 

প্রাচীন সুমেরীয় যুদ্ধরথ

৩৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়ার সুমেরে প্রচলিত যে চাকার সন্ধান পুরাতাত্ত্বিকরা পেয়েছেন, সেগুলো তিন খণ্ড কাঠ বা তক্তা জোড়া দিয়ে তৈরি হত। চাকার বাইরের দিকে তামার পেরেক ঠুকে ক্ষয়রোধ করা হত। তারপর চাকাটাকে তামার বেড়ি দিয়ে ঘেরার পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়। ক্রমশ ভরাট চাকার বদলে পাখিযুক্ত বা অরযুক্ত চাকার প্রচলন হয়। ঢাকার কেন্দ্র থেকে অরগুলো চাকার পরিধি পর্যন্ত বিস্তৃত হত।

এ চাকাগুলো সর্বাংশে আজকালকার গরুর গাড়ির চাকার মতোই ছিল। প্রথম প্রথম যে গাড়ির প্রচলন হয় তা ছিল আসলে স্লেজ-এর নিচে চাকা বসানো গাড়ীবিশেষ। ক্রমশ উন্নত ধরনের চাকাযুক্ত গাড়ি ও রথ প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়। সুমেরে চাকাওয়ালা গাড়ি আবিষ্কৃত হবার কয়েকশ বছরের মধ্যেই এটা উত্তরে আসিরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং ২৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যেই সিরিয়া, তুর্কিস্তান ও সিন্ধু অববাহিকায় এর প্রচলন ঘটে।

 

 

আরো পাঁচশো বছরের মধ্যেই ক্রীটে ও এশিয়া মাইনরে চাকাওয়ালা গাড়ির প্রচলন ঘটে। মিশরে অবশ্য অনেক পরে, ১৬৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে চাকাওয়ালা গাড়ির প্রচলন শুরু হয়েছিল॥ এবং সেটা ঘটেছিল এশিয়ার বর্বর জাতি হিক্সস্দের আক্রমণের মাধ্যমে। স্থলযানের সাথে সঙ্গতি রেখে জলযানেরও উন্নতি সাধিত হয়েছিল। মধ্য পাথরের যুগেই মানুষ ডোঙা প্রভৃতি আবিষ্কার করেছিল।

নদীতীরে অথবা নদী অববাহিকায় নতুন পাথরের যুগের গ্রাম ও তাম্ৰোপলীয় সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করার পর পরিবহণের কাজে জলযান ব্যবহারের উপযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থার মিশরে নতুন পাথরের যুগ শুরু হবার অল্পকাল পরই ৪০-৫০ জন লোক পরিবহণের উপযুক্ত প্যাপিরাসের বা নলখাগড়ার তৈরি নৌকার প্রচলন ঘটে। ২৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে মিশরে পালওয়ালা নৌকার আবিষ্কার ঘটে।

 

আরও দেখুন :

Exit mobile version