আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সভ্যতার প্রস্তুতিপর্ব
সভ্যতার প্রস্তুতিপর্ব
সভ্যতার প্রস্তুতিপর্ব
নতুন পাথরের যুগের শেষ দিকে মানুষ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সাধন করে, যার ফলে গ্রামসমাজ থেকে নগরকেন্দ্রিক সমাজে উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল। ৬০০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে মানুষ পশুতে টানা লাঙল, চাকাওয়ালা গাড়ি, পালওয়ালা নৌকা, কুমারের চাক, প্রাথমিক ধাতুশিল্প অর্থাৎ তামার আকর থেকে তামা নিষ্কাশন, প্রাথমিক ধরনের সৌর পঞ্জিকা প্রভৃতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়।
বিশেষত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে অর্থাৎ ৪০০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্য এ এ সকল সকল আবিষ্কারের অনেকগুলোই খুব দ্রুত একের পর এক ঘটতে থাকে। আরো উল্লেখযোগ্য যে, পশ্চিম এশিয়াতেই এ সকল আবিষ্কার ঘটেছিল। আবিষ্কারের ভিত্তিতেই মানুষ মিশর ও ব্যাবিলনে প্রথম নগর সভ্যতা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। আবার নগর সভ্যতা প্রতিষ্ঠার পর নাগরিক জীবনের প্রয়োজনে মানুষ লেখা, সংখ্যা গণনা ও হিসাবের পদ্ধতি, ওজন ও পরিমাপের পদ্ধতি প্রভৃতিও আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল।
নতুন পাথরের যুগ থেকে নগর সভ্যতার যুগে উত্তরণের সন্ধিক্ষণে অতি অল্প সময়ের মধ্যে যতগুলো যুগান্তকারী আবিষ্কার ঘটে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের যত প্রসার ঘটে, আধুনিক কালের আগে জ্ঞানের এত দ্রুত বিকাশ মানুষের ইতিহাসে আর ঘটেনি। অবশ্য ঐ সময়েই আকস্মাৎ কেন পশ্চিম এশিয়ায় অতি দ্রুত এ সকল আবিষ্কার ও কারিগরি জ্ঞানের বিকাশ হয়েছিল, তার বিশেষ ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে।
৪০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যে ভূমধ্য সাগরের পূর্ব অংশের তীরভূমি থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশ পর্যন্ত সর্বত্র নতুন পাথরের যুগের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল। নতুন পাথরের যুগে কৃষিজীবী মানুষ ছাড়াও এ সকল অঞ্চলে অবশ্য শিকারী, ম ৎস্যজীবী, পশুপালক দল ইত্যাদি ছিল। নতুন পাথরের যুগের সংস্কৃতি অবশ্য এ পরিসীমার বাইরেও সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছিল।
কিন্তু বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অনুকূল সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে পশ্চিম এশিয়াতেই নবোপলীয় সংস্কৃতির আবিষ্কার ঘটেছিল বলে এ অঞ্চলের প্রাণবন্ত সমাজের পক্ষে স্বভাবতই নতুন নতুন জান আবিষ্কারকে আত্মস্থ করা সহজ এবং সম্ভবপর ছিল। মিশর-প্যালেস্টাইন-লেবানন থেকে শুরু করে সিন্ধু উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা মানুষরা বিভিন্ন পরিবেশে যে সকল জ্ঞান ও কারিগরি কৌশল আয়ত্ত করে, তা ক্রমশ সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
এভাবে ভৌগোলিক, ভূতাত্ত্বিক, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, কৃষি, ধাতুবিদ্যা, যন্ত্রবিদ্যা, স্থাপত্যবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে আবিষ্কৃত জ্ঞান ও কৌশল ক্রমশ এক এক স্থানে সঞ্চিত হতে শুরু করে। কিন্তু ওপরে যেসব কারিগরি আবিষ্কারের কথা বলা হয়েছে, সব অঞ্চলের নতুন পাথরের যুগের গ্রাম সমাজের পক্ষে সেগুলোকে কাজে লাগানো সম্ভব ছিল না। যেমন, ধাতুর কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ কারিগর দরকার।
যে কর্মকার আকর থেকে তামার যন্ত্র তৈরি করবে, তাকে কাজ শেখার জন্য এবং তারপর কাজ করার জন্যে সর্বক্ষণ ঐ কাজেই নিয়োজিত থাকতে হবে। এ ধরনের বিশেষজ্ঞের খাদ্য উৎপাদন করে সমাজের অবশিষ্ট মানুষরা। অর্থাৎ যেসব সমাজ উদ্বৃত্ত বা বাড়তি খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পারত, সেসব সমাজই কেবল কারিগর শ্রেণীর পরিপোষণ করতে পারত।
সিরিয়ার তৃণভূমি বা ইরানের মালভূমি প্রভৃতি অঞ্চলে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ খুব বেশি না থাকায় এসব অঞ্চলের মানুষের পক্ষে বেশি পরিমাণ উদ্বৃত্ত শস্য উৎপাদন সম্ভব ছিল না। তাই এ সকল অঞ্চলের সমাজের পক্ষে বেশিসংখ্যক কারিগর পরিপোষণ করা সম্ভব ছিল না। অথচ ওপরে যেসব আবিষ্কারের কথা বলা হল, সেগুলোর মধ্যে এমন প্রচণ্ড ক্ষমতা লুকিয়ে ছিল যে তাদের সাহায্যে এক অতি সমৃদ্ধিশালী নগরসভ্যতা গড়ে তোলা চলত।
কিন্তু এ সকল কারিগরি আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে নতুন সভ্যতা শুরু করার মতো প্রারম্ভিক যোগ্যতা ছিল পশ্চিম এশিয়ার কয়েকটি নদীতীরবর্তী অঞ্চলের। এ সকল পলিভূমিতেই কেবল প্রচুর পরিমাণে উদ্বৃত্ত শস্য উৎপাদন সম্ভবপর হয়েছিল, যার সাহায্যে বিপুলসংখ্যক কারিগরশ্রেণীর পরিপোষণ সম্ভব হয়েছিল। অপরপক্ষে উল্লিখিত কারিগরি আবিষ্কারের ফলেই এ সকল নদীতীরবর্তী জলাভূমিতে চাষাবাদ সম্ভব হয়েছিল।
কিভাবে নতুন কারিগরি আবিষ্কারের ভিত্তিতে নীল নদের তীরে মিশরে এবং টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের মধ্যবর্তী সুমের ব্যাবিলনিয়ায় নতুন নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা নির্মিত হয়েছিল, তা আমরা একটু পরেই বিশদভাবে আলোচনা করছি, তাই এখানে এ সম্পর্কে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই ৷
আরও দেখুন :