এন্টোনিন রাজবংশ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় এন্টোনিন রাজবংশ

এন্টোনিন রাজবংশ

 

 

এন্টোনিন রাজবংশ

দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোম এন্টোনিন রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়। ডোমিটিয়ানের মৃত্যুর পর সিনেট নার্ভা নামক একজন সাধারণ নাগরিককে রোমের সিংহাসনে বসায়। সম্রাট নার্ভা (৯৬ খ্রিঃ-৯৮ খ্রিঃ) ডোমিটিয়ান কর্তৃক নির্বাসিতদের দেশে ফিরে আসার অনুমতি দেন এবং জনগণের উপর আরোপিত অনেক কর মওকুফ করে দেন।

নার্ভার মৃত্যুর পর তাঁর পালিত পুত্র ট্রেজান রোমের সম্রাট হন (৯৮ খ্রিঃ-১১৭ খ্রিঃ) টেজানের সময় রাজ্যের সীমা ডেসিয়া, আর্মেনিয়া, আরব ও মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। রোম সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তার ট্রেজানের সময়েই ঘটেছিল। ট্রেজান-এর পরবর্তী শাসক ছিলেন হেড্রিয়ান (শাসনকাল ১১৭ খ্রিঃ-১৩৮ খ্রিঃ)। হেন্ড্রিয়ানের পরে সম্রাট হয়েছিলেন যথাক্রমে এন্টোনিনাস পায়াস্ (১৩৮ খ্রিঃ-১৬১ খ্রিঃ পর্যন্ত) এবং মার্কাস্ অরেলিয়াস (১৬১ খ্রিঃ-১৮০ খ্রিঃ পর্যন্ত)।

মার্কাস অরেলিয়াস-এর শাসনকালেই বর্বর জার্মান জাতি সর্বপ্রথম রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তে আক্রমণ চালায়। দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোম সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তার ঘটে। উত্তরে স্কটল্যাণ্ড থেকে দক্ষিণে নীলনদ পর্যন্ত এবং পাশ্চিমে আটলান্টিকের উপকূল থেকে পূর্বে পারস্য উপসাগরের সীমা পর্যন্ত এ সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। দাসভিত্তিক সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পাই এ শতাব্দীতে।

দেশের প্রায় সমগ্র ভূসম্পদ ও কারিগরি শিল্পকে কেন্দ্র করে এ অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল ব্যাপক দাশশ্রমের ভিত্তিতে। বহির্বাণিজ্যের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। ফলে দাস-মালিকগণ তাদের ক্রীতদাসদের অমানুষিক শ্রমে নিয়োজিত করে সর্বোচ্চ মুনাফা আদায় করতে থাকে। শোষণ ও নির্যাতনের পরিমাণ এত অধিক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল যে, ক্রীতদাসদের পক্ষে তা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। ক্রীতদাসরাও এখন হিংস্র জীবে পরিণত হয়ে পড়ে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সামান্য কারণে তাদের জেলে অটকে রাখা, চাবুক মারা ও একেবারে মেরে ফেলা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ক্রীতদাসদের সর্বক্ষণ ভয় ও ভীতি দেখিয়ে কাজ আদায় করতে হত এবং এভাবে তাদের শ্রমকে নিয়োজিত করে রোমের দাসমালিকগণ মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। রোমান সাম্রাজ্যের এই সমৃদ্ধি শুধুমাত্র রোম বা তার আশেপাশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সমগ্র ইতালি উপদ্বীপ,গল,স্পেন ও প্রাচ্যের দূর-দূরান্তে এ সমৃদ্ধি ছড়িয়ে পড়েছিল।

এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ার উপকূল ধরে অনেকগুলি বাণিজ্য বন্দর গড়ে ওঠে এবং এগুলির মাধ্যমে ভারত, চীন ও পূর্বের দেশগুলির সাথে রোমের বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সমৃদ্ধি রোমে উচ্চশ্রেণীর নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানকে বহুগুণ উন্নীত করে। রোমের সম্রাট, অমাত্য, পাত্রমিত্র, সেনাধ্যক্ষগণ, প্রাদেশিক শাসকগণ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, পুরোহিতবৃন্দ, ধনী ব্যবসায়ী ও দাস-মালিকগণ চরম বিলাসিতায় আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে এক পরম সুখের জীবন যাপন করছিলেন।

এদের সুখের উপকরণ যোগাতে গিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ কৃষককে ভূমিহীন সর্বহারায় এবং ক্রমে ক্রমে ঋণদাস ও পরে ক্রীতদাসে পরিণত হতে হয়। লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাসকে অমানুষিক শ্রমে জীবনীশক্তি ক্ষয় করে ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে যেতে হয়। আর রোমান সাম্রাজ্যের অগণিত সাধারণ নাগরিককে বিপুল করভারে নিষ্পেষিত হয়ে সর্বস্ব হারাতে হয়।

 

 

এর পরিণামস্বরূপ দেখা দেয় প্রচণ্ড অরাজকতা— সামরিক বাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতা, ঘন ঘন দাসবিদ্রোহ ও সর্বশেষে বহিঃশত্রুর আক্রমণ। রোমের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও ক্রীতদাসপ্রথার পরিণাম এমন ভয়াবহভাবে দেখা দিল, যা সমগ্র রোমান সাম্রাজ্য তার সর্বশক্তি দিয়েও প্রতিরোধ করতে সক্ষম হল না ।

আরও দেখুন :

ক্লডিয়ান রাজবংশ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ক্লডিয়ান রাজবংশ। ইম্পেরিয়াল রোমের প্রথম রাজবংশ, যার সূচনা ১৯ আগস্ট, ১৪ খ্রিস্টাব্দে অগাস্টাসের মৃত্যুর পর। ৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বংশ টিকে ছিল। চারজন সম্রাট এসময় রাজত্ব করেন।

ক্লডিয়ান রাজবংশ

কালিগুলার মৃত্যুর পর সিনেট পরবর্তী শাসক ঠিক করতে আলোচনায় বসল। প্রথমে রিপাবলিক পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বললেও দ্রুতই সিনেটরেরা নিজেদের নাম রাজা হিসেবে প্রস্তাব করতে থাকলেন। এদিকে প্রিটোরিয়ান গার্ড নিজেরাই সম্রাট বেছে নিল। তিনি কালিগুলার চাচা আর টিবেরিয়াসের ভ্রাতুষ্পুত্র ক্লডিয়াস। সেনাদের চাপে সিনেট তার নিয়োগ বৈধতা দিতে বাধ্য হল। ক্লডিয়াসের সৎ ছেলের নাম ছিল নিরো। ক্লডিয়াসের শাসনামলের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ব্রিটেনে রোমের আগ্রাসন। ১৬ দিনের ক্যাম্পেইনে তিনি পরবর্তীতে ব্রিটেন জয় করার ভিত্তি স্থাপন করে যান।এছাড়াও টিবেরের মুখে নতুন বন্দর নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের নালা (AQUA CLAUDIA) স্থাপন এবং ফসিন লেক শুকিয়ে চাষাবাদের জন্য বিশাল এলাকা উদ্ধার তার সময়ের কাজ।

 

 

ক্লডিয়ান রাজবংশ

অগাস্টাস সীজার কোনো উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সৎ ছেলে টাইবেরিয়াস ক্লডিয়াস রোমের পরবর্তী শাসক নিযুক্ত হন। টাইবেরিয়াসের পর আরও তিনজন শাসক এই ক্লডিয়ান বংশ থেকে নিযুক্ত হন। ক্লডিয়ান বংশের সর্বশেষ সম্রাট হলেন নীরো।

দুর্নীতি, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা ও চরম বিলাসিতার সাথে নীরোর নামটি ইতিহাসে যুক্ত রয়েছে। তিনি নিজ হাতে তাঁর মাতা, ভ্রাতা ও স্ত্রীকে হত্যা করেন। তাঁর সময়ে রোমে এক বিরাট অগ্নিকাণ্ড ঘটে। অনেকের মতে নীরো নিজেই এই অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী। সমগ্র রোম শহরের প্রায় অর্ধাংশ এই অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়। নীরো এই অগ্নিকাণ্ড নেভাবার কোনো চেষ্টা তো করেনইনি, উপরন্তু রোম শহর যখন পুড়ছিল, নীরো মনের সুখে তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এই অগ্নিসংযোগের জন্য তিনি খ্রিস্টানদের দায়ী করেন এবং বহু খ্রিস্টানকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। চরম বিলাসিতা ও অমিতব্যয়িতার জন্য নীরো সব সময় অর্থের প্রয়োজন অনুভব করতেন। এজন্য তিনি অনেক ধনী ব্যক্তিকে হত্যা করে তাঁদের অর্থ আত্মসাৎ করেন।

তাঁর নিষ্ঠুরতার জন্য তিনি অল্পদিনের মধ্যে সকলের শত্রুরূপে চিহ্নিত হন এবং যখন তিনি গ্রীসে অবস্থান করছিলেন তখন গল ও স্পেনে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়।

 

 

তিনি রোমে ফিরে এলেন কিন্তু সিনেট ইতিমধ্যেই তাকে গণশত্রুরূপে ঘোষণা করে এবং সমগ্র রোমেই তাঁর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়। উপায়ান্তর না দেখে তিনি প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন।

 

আরও দেখুন :

সাম্রাজ্যিক রোমের ইতিহাস

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সাম্রাজ্যিক রোমের ইতিহাস

সাম্রাজ্যিক রোমের ইতিহাস

 

 

সাম্রাজ্যিক রোমের ইতিহাস

মার্ক এন্টনীকে পরাজিত করার পর অক্টেভিয়ান রোমের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক রূপে আবির্ভূত হলেন। অত্যন্ত সুচতুর অক্টেভিয়ান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে সীজারের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা তাঁর পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, কারণ তাতে তিনি জনসমর্থন হারাবেন। কাজেই কৌশলে তিনি এ ব্যাপারে অগ্রসর হলেন। তিনি প্রথমে ঘোষণা করলেন যে, রোম প্রজাতন্ত্রকে তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন।

সিনেট তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রদান করল এবং তাঁকে ‘অগাস্টাস’ উপাধিতে ভূষিত করল। এখন থেকে অক্টেভিয়ান ‘অগাস্টাস সীজার’ নামে পরিচিত হলেন। পরবর্তী কালে প্রতিটি রোমান সম্রাট ‘অগাস্টাস সীজার’ উপাধি ধারণ করতেন। এমনকি রোম সাম্রাজ্যের পতনের প্রায় তিনশত বছর পরে বর্বর ফ্রাঙ্ক রাজা শার্লামেনও এই উপাধি ধারণ করে নিজেকে রোমান সম্রাট ঘোষণা করেন।

অগাস্টাস নিজেকে সিনেটরদের মধ্যে ‘প্রথম’ (Princep) বলে ঘোষণা করলেন। অগাস্টাস-এর শাসনকালকে বলা হয় প্রিন্সিপেট (Principate) বাস্তবিকপক্ষে অগাস্টাস রোম প্রজাতন্ত্র সৃষ্টির অন্তরালে রাজতন্ত্রকেই সৃষ্টি করেছিলেন। সিনেটকে মুখে সম্মান দেখালেও আসলে তিনি সিনেট ও গণপরিষদ উভয়কেই তাঁর আজ্ঞাবহ যন্ত্রে পরিণত করেন। তিনি সিনেট কর্তৃক তের বার কন্সাল পদে নিযুক্ত হন।

সিনেট তাঁকে রোমের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে নিযুক্ত করে। অন্যদিকে ম্যাজিস্ট্রেট ও সিনেটের উপর কর্তৃত্ব করার সর্বময় ক্ষমতা এবং যে কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ভেটো (নাকচ করা) প্রয়োগের সর্বোচ্চ ক্ষমতা তাঁকে দেয়া হয়। রোমের ধর্ম-মন্দিরের প্রধান পুরোহিতরূপেও তিনি অধিষ্ঠিত হন। অগাস্টাসের পূর্বে রোমের আর কোনও শাসক এতখানি ক্ষমতা ভোগ করেননি।

রোমের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী অগাস্টাস ‘সম্রাট’ উপাধি গ্রহণ না করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন রোমের প্রথম সম্রাট ও রোম সাম্রাজ্যের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। রোম প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য জুলিয়াস সীজারের শত্রুরা তাঁকে হত্যা করলেও গণতন্ত্রকে বাঁচানো গেল না। অগাস্টাস সীজার রোমের গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে ফেলে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। রোমের জনসাধারণের জন্য অগাষ্টাস কিছু কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তাঁর সময়ে করের বোঝা কমানো হয় এবং প্রাদেশিক গভর্নরদের নিয়মিত বেতন দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে তাঁরা প্রজাদের নিকট থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় না করেন। সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে যতদূর সম্ভব দুর্নীতিমুক্ত করা হয়। দরিদ্র জনগণকে বিনামূল্যে অনেক সময় খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করা হত এবং সাধারণ নাগরিকদের মনোরঞ্জনের জন্য খেলাধুলা ও অন্যান্য আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করা হয়।

কিন্তু সবচেয়ে অধিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয় ক্রীতদাস-মালিকদের জন্য। অগাস্টাস আইন জারি করেন যে, কোনো দাস-মালিককে হত্যা করা হলে তার সব কয়টি ক্রীতদাসকে হত্যা করা হবে। তিনি আরও নির্দেশ জারি করেন যে মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাস কখনই সমাজের উঁচু শ্রেণীতে প্রবেশাধিকার পাবে না। অগাস্টাস রোমের সামরিক বাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করেন, কারণ রাজ্যজয় অপেক্ষা কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতিসাধন তাঁর অধিক কাম্য ছিল।

তিনি প্রিটোরিয়ান গার্ড নামে সম্রাটের দেহরক্ষী বাহিনীর একটি নতুন দল তৈরি করেন এবং এদের সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়।অগাস্টাসের শাসনকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যীশুখ্রিস্টের জন্মগ্রহণ (১ খ্রিস্টাব্দ)।

 

 

যীশুখ্রিস্ট ও তাঁর অনুসারীগণ কর্তৃক রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এবং এর পর থেকেই রোমের সম্রাটের শক্তি ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে খ্রিস্টধর্ম একটি চ্যালেঞ্জরূপে আবির্ভূত হয়। ইতিমধ্যে রোমে বিভিন্ন প্রাচ্য ধর্মবিশ্বাস, যথা, মিথ্ৰাসবাদ, সিবিল দেবীর পূজা প্রভৃতি ধর্মমতকেও খ্রিস্টধর্ম স্থানচ্যুত করে। মধ্যযুগের ইতিহাস আলোচনাকালে আমরা খ্রিস্টধর্মের উৎপত্তি ও বিস্তারের ইতিহাস বিবৃত করব। অগাস্টাস সীজার ৪৫ বছর পর্যন্ত রোমের একচ্ছত্র সম্রাটরূপে রাজত্ব করে ১৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন।

আরও দেখুন :

রোমের গৃহযুদ্ধ এন্টনী ও অক্টেভিয়ান

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় রোমের গৃহযুদ্ধ এন্টনী ও অক্টেভিয়ান

রোমের গৃহযুদ্ধ এন্টনী ও অক্টেভিয়ান

 

 

রোমের গৃহযুদ্ধ এন্টনী ও অক্টেভিয়ান

সীজারের হত্যাকাণ্ড রোমকে আরেকবার গৃহযুদ্ধে নিক্ষেপ করে। সীজারকে হত্যা করে ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস রোমের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু রোমের জনসাধারণ সীজারের মৃত্যুতে এতখানি শোকাভিভূত হয়ে পড়ে যে ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস ভীত হযে রোম ছেড়ে পালিয়ে যান। মার্ক এন্টনী বিপুলসংখ্যক জনসমর্থনের মাধ্যমে সীজারের স্থলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু অচিরেই তিনি আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাক্ষাৎ পান।

এ নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন অক্টেভিয়ান— ইনি ছিলেন সীজারের নিকটতম আত্মীয় ওপালিত পুত্র, এঁকেই সীজার তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। অষ্টাদশ বছরের অক্টেভিয়ান অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ছিলেন। এন্টনীর বিরুদ্ধে তিনি প্রথমেই যুদ্ধ ঘোষণা না করে বরং রোমের আরেকজন নেতা লেপিডাস-এর সাথে একত্রিত হয়ে এন্টনীর কাছে জোট গঠনের প্রস্তাব দিলেন। খ্রিস্ট পূর্ব ৪৭ অব্দে এন্টনী, অক্টেভিয়ান ও লেপিডাস দ্বিতীয় ট্রায়ামভায়রেট গঠন করলেন।

বিশাল রোমান সাম্রাজ্য এ তিনজন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলেন। এন্টনীকে দেয়া হল পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলির ভার, অক্টেভিয়া পেলেন পশ্চিমাঞ্চলের কর্তৃত্ব এবং আফ্রিকার অংশ দেয়া হল লেপিডাসকে। ট্রয়ামভায়রেট-এর প্রথম কাজ হল জুলিয়াস সীজারের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া। হত্যাকাণ্ডের প্রধান নায়ক ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসকে শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে এন্টনী ও অক্টেভিয়ান একত্রে পূর্বদিকে অভিযানে বহির্গত হলেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তাঁরা আড্রিয়াটিক সাগর অতিক্রম করে থ্রেস-এ পৌঁছালেন। সেখানে তাঁরা ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস-এর দেখা পেলেন। ফিলিপির যুদ্ধে ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসকে তাঁরা পরাজিত করলেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস উভয়েই আত্মহত্যা করেন। ফিলিপির যুদ্ধে সাফল্য লাভের পর অক্টেভিয়ান রোমে ফিরে এলেন। এন্টনী গ্রীস ও এশিয়া মাইনরের দিকে অগ্রসর হলেন সেখানকার অবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্তে আনার উদ্দেশ্যে।

মিশরে উপস্থিত হয়ে তিনি ক্লিওপেট্রার সাক্ষাৎ পেলেন। প্রাচ্যের সুন্দরীর রূপে মুগ্ধ হয়ে এন্টনী নিজ কর্তব্য সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হলেন। দিনের পর দিন মিশরের রাজপ্রাসাদের বিলাস ব্যসনের মধ্যে এন্টনীর দিন কাটতে লাগল । এদিকে এন্টনীর শত্রুরা রোমে প্রচার করতে লাগল, এন্টনী আলেকজান্দ্রিয়াকেই রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করতে চান। অক্টেভিয়ান এ সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন।

তিনি সিনেটকে নির্দেশ দিলেন এন্টনীকে প্রাচ্যের শাসনকর্তার পদ থেকে বিচ্যুত করতে। অক্টেভিয়ান অতঃপর এন্টনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এন্টনীও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। মিশরের সৈন্যবাহিনী এন্টনীকে সম্পূর্ণভাবে সহায়তা করল। গ্রীসের পশ্চিম তীরে এক্টিয়াম নামক স্থানে উভয়ের মধ্যে বিরাট নৌ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দেখে ক্লিওপেট্রা তাঁর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে পলায়ন করলেন। এন্টনী যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে ক্লিওপেট্রার সাথে পালিয়ে গেলেন।

 

 

পরাজিত ও বিধ্বস্ত মিশরীয় নৌবাহিনীর অবশিষ্টাংশ অক্টেভিয়ান-এর নিকট আত্মসমর্পণ করল। পরাজয়ের সংবাদে এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা উভয়েই আত্মহত্যা করলেন। মিশর এখন থেকে রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত হল। অক্টেভিয়ান-এর শেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যুর সাথে সাথে রোমের গৃহযুদ্ধেরও সমাপ্তি ঘটে।

আরও দেখুন :

সিজারের একনায়কত্ব

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সিজারের একনায়কত্ব। জুলিয়াস সিজার ছিলেন রোম সাম্রাজ্যের একজন সেনাপতি এবং একনায়ক; এছাড়া লাতিন ভাষায় রচিত তার লেখা গদ্যসাহিত্যও উল্লেখের দাবি রাখে। তাঁকে ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বলে বিবেচনা করা হয়। যে সমস্ত ঘটনার ফলে তার সমসাময়িক ও ঠিক তার পরবর্তী যুগে রোমের প্রশাসনিক চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় ও রোম একটি গণতন্ত্র থেকে একটি একনায়ককেন্দ্রিক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়, সেইসমস্ত ঘটনায় জুলিয়াস সিজারের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য।”এলাম দেখলাম জয় করলাম”এটি ছিলো জুলিয়াসের বানী।অবাক করা বিষয় রোমান সভ্যতা নদী মাতৃক ছিলো না।

৪৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের শেষপর্যন্ত তিনি রোমের একনায়ক ছিলেন; ৪৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে প্রায় দশ বছরের দায়িত্বে এবং ৪৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ অনন্ত একনায়কত্ব হিসেবে।

সিজারের একনায়কত্ব

 

 

সীজারের একনায়কত্ব

পম্পির বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবসানের পর সীজার রোমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হলেন। পূর্বেই তাঁকে দশ বছরের জন্য রোমের একনায়ক নিযুক্ত করা হয়েছিল। এখন থেকে তিনি রোমের আজীবন একনায়ক নিযুক্ত হলেন। অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী হলেন সীজার। গণপরিষদের আর কোনও ক্ষমতা রইল না এবং সিনেটও সীজারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল।

সীজারের একনায়কত্বের কালে রোমে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধিত হয়েছিল। প্রথমত, স্পেন ও গলবাসীদেরকে রোমান নাগরিকের অধিকার দান করে তিনি বহুদিনের একটি মৌলিক সমস্যার সমাধান করেন। দ্বিতীয়ত, দরিদ্র বেকার শহরবাসীদের তিনি ইতালি ও রোমের অন্যান্য প্রদেশে অব্যবহৃত সরকারি জমিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তৃতীয়ত, গ্রীক জ্যোতির্বিদদের সাহায্যে তিনি প্রচলিত ক্যালেণ্ডারের সংস্কার সাধন করেন। ৩৬৫ দিনে এক বছর এবং প্রতি চার বছরের সাথে একদিন অতিরিক্ত যোগ করে তিনি যে ক্যালেণ্ডার প্রবর্তন করেন, তা ঈষৎ পরিবর্তনসহ (১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী কর্তৃক যে পরিবর্তন সাধিত হয়) অদ্যাবধি প্রচলিত রয়েছে। তা ছাড়া রোমান আইনের সংস্কার সাধনেও তিনি সচেষ্ট হন।

কিন্তু সীজারের রাজনৈতিক কার্যকলাপ তাঁর শত্রুদের মধ্যে এমন ধারণার সৃষ্টি করেছিল যে, তিনি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছেন। তাঁরা সীজারের এ কার্যে বাধাদানের উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।

 

 

খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দের ১৫ই মার্চ সিনেটের অধিবেশন চলাকালে সীজার এ ষড়যন্ত্রের দুজন মূল কর্ণধার ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস কর্তৃক ছুরিকাঘাতে নিহত হন।

আরও দেখুন :

রোমের গৃহযুদ্ধ পম্পি ও সীজার

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় রোমের গৃহযুদ্ধ পম্পি ও সীজার

রোমের গৃহযুদ্ধ পম্পি ও সীজার

 

 

রোমের গৃহযুদ্ধ পম্পি ও সীজার

স্পার্টাকাসের দাসবিদ্রোহ যখন নির্মম হাতে দমন করা হচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই প্রস্তুতি চলছিল রোমের গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের। এ গৃহযুদ্ধের নায়ক ছিলেন পম্পি ও সীজার— রোমের দু’জন দিগ্বিজয়ী সামরিক অধিনায়ক। পম্পি ছিলেন সুলার বন্ধু এবং মারিয়াস ও সুলার মধ্যে অনুষ্ঠিত গৃহযুদ্ধে সুলার পক্ষ নিয়ে লড়াই করেন। স্পার্টাকস-এর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত দাসবিদ্রোহ দমনের কাজেও পম্পিকে পাঠানো হয় ক্রেসাস-এর বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য।

বিলম্বে পৌঁছালেও পম্পি নিহত স্পার্টাকাসের অবশিষ্ট সৈন্যদলকে নির্মমভাবে ধ্বংস করেন। ভূমধ্যসাগরে জলদস্যুদের দমন করার কাজেও তিনি বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। পম্পির উপর এর পর দেয়া হয় পূর্ব দিকে মিথ্রিডেটিসকে পুনরায় দমন করার ভার। অল্প সময়ের মধ্যে পম্পি মিথ্রিডেটিস-এর বাহিনীকে পরাজিত করেন। মিথ্রিডেটিস ক্রিমিয়ায় পালিয়ে যান এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

পম্পি এবার এশিয়া মাইনর ও সিরিয়া জয় করেন এবং ইউফ্রেটিস নদীর তীর পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃত করেন। পম্পি যখন পূর্ব দিকে তাঁর সামরিক অভিযানে ব্যাপৃত ছিলেন, ঠিক তখনই আরেকজন সামরিক অধিনায়ক জুলিয়াস সীজার পশ্চিমে একের পর এক রাজ্য রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে যাচ্ছিলেন। রোমের এই ব্যাপক সামরিক অভিযানের কালেই আরেকটি নাটকের মহড়া চলছিল রোম শহরের অভ্যন্তরে।

এ নাটকের নায়ক ক্যাটিলাইন একজন অভিজাত বংশোদ্ভূত, যিনি তিন তিনবার কন্সাল পদে মনোনয়নলাভে ব্যর্থ হয়ে এক গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন। রোমের ম্যাজিস্ট্রেট ও ধনী ব্যক্তিদের হত্যা করে তিনি সমগ্র রোম প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। তাঁর এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে বিখ্যাত রোমান বক্তা সিসেরো তা সিনেটের অধিবেশন চলাকালে ফাঁস করে দেন।

ক্যাটিলাইন ইতোমধ্যেই পলায়ন করে ইব্রুরিয়া নামক স্থানে তাঁর ক্ষুদ্র সৈন্যদল সমবেত করেন। এর বিরুদ্ধে সিনেট এন্টোনিনাস-এর অধীনে এক বিরাট দল প্রেরণ করে। যুদ্ধে ক্যাটিলাইন ও তাঁর তিন হাজার সহচর পরাজিত ও নিহত হন । ক্যাটিলাইনের ষড়যন্ত্র নির্মূল করার পরে রোমের রাজনৈতিক ক্ষমতা তিনজন সামরিক অধিনায়কের হাতে তুলে দেয়া হয়। এঁরা হলেন পশি, ক্রেসাস ও জুলিয়াস সীজার।

খ্রিস্টপূর্ব ৬০ শতাব্দীতে এঁরা প্রথম ট্রায়ামভায়রেট (First Triumvirate) বা ‘ত্রয়ী শাসক’ গঠন করেন। সমগ্র রোমান সাম্রাজ্য তিনজন অধিনায়ক নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন। রোমের দাস-মালিকগণ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কোনো সিনেট বা গণতান্ত্রিক সংস্থা অপেক্ষা সামরিক নেতাদের শাসনব্যবস্থাই সর্বোৎকৃষ্ট বলে মনে করে। পম্পিকে দেয়া হয় রোমের শাসনভার এবং সিনেটের উপর খবরদারীর নেতৃত্ব।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ক্রেসাসকে দেয়া হল পূর্বাঞ্চলের ক্ষমতা এবং গেইয়াস জুলিয়াস সীজার পাঁচ বছরের জন্য রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত হলেন। পশ্চিমের গল (বর্তমান ফ্রান্স) রাজ্য দখল করার উদ্দেশ্যে সীজার তাঁর বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। একাদিক্রমে সাত বছর সামরিক অভিযান চালানোর পর গল রাজ্য দখল করা হল।

তাঁর শাসনকাল আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫ অব্দে সীজার রাইন নদী অতিক্রম করে বর্বর জার্মান জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং এর পর বছরই ব্রিটেনে পদার্পণ করেন। ব্রিটেনে কয়েকটি জাতিকে পরাজিত করতে সক্ষম হলেও রোমান শাসন ব্রিটেনে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে নি। ইতিমধ্যে গলে আবার বিদ্রোহ দেখা দেয়। কিন্তু সীজার অসামান্য সামরিক কুশলতার সাথে এ বিদ্রোহ দমন করেন। গল বিজয়ের ফলে প্রচুর ধনরত্ন ও প্রায় দশ লক্ষ ক্রীতদাস সীজার লাভ করেন।

এ সকল কাজ তাঁর জনপ্রিয়তা বহুলাংশে বৃদ্ধি করে। সীজারের গল বিজয়ের সমাপ্তির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ট্রায়ামভায়রেট-এরও সমাপ্তি ঘটে। ক্রেসাস পার্থিয়াতে মারা যান। বাকি রইলেন পম্পি ও সীজার। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিতে কেউ কারও কম নন, কাজেই দু’জনের প্রত্যেকেই চাইলেন অপরজনকে ক্ষমতাচ্যুত করে রোমে সর্বময় ক্ষমতা নিজ করায়ত্ত করতে।

দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের শেষ চিহ্নটুকুও অবলুপ্ত হ’ল যখন সীজারের কন্যা ও পম্পির স্ত্রী জুলিয়া সন্তানের জন্মদানকালে মারা যান। পম্পি ও সীজার পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হলেন এবং রোম আরেকবার গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হল। জুলিয়াস সীজার তাঁর বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে রোমের দিকে অগ্রসর হন এবং সিনেটের নিষেধ সত্ত্বেও রুবিকন (সীজার ও পম্পির রাজ্যের সীমারেখা) অতিক্রম করে রোমের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হলেন।

সীজারের আগমনের সংবাদ পেয়ে পম্পি কয়েকজন সিনেটরকে সাথে নিয়ে গ্রীসে পালিয়ে যান। সীজার তক্ষুণি পম্পিকে অনুসরণ না করে রোমে তাঁর ক্ষমতা সংগঠিত করার চেষ্টায় লিপ্ত হন। পম্পির অনুগত সৈন্যদল সীজারকে বাধাদানের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। রোমবাসীরা আরেকবার গৃহযুদ্ধের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু সীজার প্রতিহিংসাপরায়ণ না হয়ে সকলকে তাঁর পক্ষে যোগদানের আহ্বান জানান। এর ফলে রোমের বিপুল জনতা তাঁর পক্ষাবলম্বন করে।

 

 

যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি পম্পির দেখা পান। যুদ্ধে পম্পি পরাজিত হয়ে মিশর অভিমুখে পলায়ন করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি এক গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। সীজার এরপর মিশরে গমন করেন এবং মিশর-সম্রাজ্ঞী বিশ্ববিখ্যাত ক্লিওপেট্রার সাথে সাক্ষাৎ করেন। মিশরের রাজপ্রাসাদে কিছুকাল অবস্থানের পর তিনি পুনরায় সামরিক অভিযানে বহির্গত হন।

প্রথমে সিরিয়াতে ও পরে আফ্রিকায় পম্পির সমর্থকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। সীজারের শেষ অভিযান পরিচালিত হয় স্পেনের মুণ্ডা নামক স্থানে, যেখানে পম্পির বাহিনী শেষবারের মতো সীজারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং পরাজিত হয়।

আরও দেখুন :

ঐতিহাসিক দাসবিদ্রোহ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ঐতিহাসিক দাসবিদ্রোহ

ঐতিহাসিক দাসবিদ্রোহ

 

 

ঐতিহাসিক দাসবিদ্রোহ

রোমের গৃহযুদ্ধের অবকাশে আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনার প্রস্তুতি চলছিল। তা হল, স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে পরিচালিত ইতিহাসের সর্ববৃহৎ দাসবিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের প্রথম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ক্যাপুয়া শহরে কয়েকজন মল্লযোদ্ধা ক্রীতদাস কর্তৃক। এ ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। কিন্তু প্রায় আশিজন ক্রীতদাস পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ভিসুভিয়াস পর্বতে তারা শিবির স্থাপন করে এবং স্পার্টাকাসকে তাদের নেতা নির্বাচিত করে।

তিনি ছিলেন নিঃসেন্দেহে একজন অবিসংবাদী নেতা, উপযুক্ত সংগঠক ও সুদক্ষ সামরিক অধিনায়ক। তাঁর জন্মস্থান ছিল থ্রেস্-এ। সেখান থেকে তিনি ক্রীতদাসরূপে রোমে আনীত হন। বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার অপরাধে শাস্তিস্বরূপ তাঁকে গ্লাডিয়েটর বা মল্লযোদ্ধা ক্রীতদাসরূপে নিযুক্ত করা হয়। প্রথম দিকে দাসবিদ্রোহের গুরুত্ব বুঝতে না পারায় রোম এদিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়নি।

কিন্তু স্পার্টাকাসের অধীনস্থ দাসবাহিনী দ্রুত বৃদ্ধি পেতে লাগল। তখন বিরাট রোমান সৈন্যদল প্রেরিত হল এ বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে। রোমানবাহিনী ভিসুভিয়াসে ওঠার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়াল এবং স্পার্টাকাসের বাহিনীর সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিল। এ বিপদে স্পার্টাকাস পরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। ভিসুভিয়াসের উপরে ছিল আঙুরের বিস্তৃত ক্ষেত।

স্পার্টাকাসের নির্দেশে তাঁর বাহিনী আঙুরের লতা দিয়ে শক্ত দড়ি তৈরি করল এবং তার সাহায্যে গভীর রাত্রির অন্ধকারে পাহাড় থেকে নেমে পড়ল। দলে দলে এভাবে দাসসৈন্যরা ভিসুভিয়াস থেকে অবতরণ করে রোমান সৈন্যদের শিবির অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের সমূলে ধ্বংস করে দিল। স্পার্টাকাস বাহিনীর এ বিজয়ের খবরে উল্লসিত হয়ে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রীতদাসরা পালিয়ে এসে তাঁর দলে যোগদান করল।

অচিরেই স্পার্টাকাসের বাহিনী কয়েক হাজারে উন্নীত হল এবং দাসবিদ্রোহ সমগ্র ইতালিতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। স্পার্টাকাসের উদ্দেশ্য ছিল ক্রীতদাসদের ইতালি থেকে সরিয়ে নিয়ে প্রত্যেককে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া। কিন্তু তাঁর বাহিনীতে বিভিন্ন জাতির সমাবেশ ঘটেছিল : থ্রেসিয়ান, গ্রীক, গল ও জার্মান। এদের সবাইকে একই নীতিতে বিম্বাস করানো বাস্তবিকপক্ষেই ভীষণ কঠিন কাজ ছিল।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এদের মধ্যে কোনো কোনো দল ইতালি পরিত্যাগ না করে সরাসরি রোম আক্রমণের পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু স্পার্টাকাস বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর বাহিনী রোম আক্রমণ করার মতো অতখানি শক্তিশালী ছিল না। কাজেই এ ব্যাপারে তিনি স্বতন্ত্র মত পোষণ করতেন। তাঁর সাথে ভিন্নমত হওয়ার দরুন দুটি দল তাঁর বাহিনী পরিত্যাগ করে যায়৷ এটা পরবর্তীকালে তাঁর বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্পার্টাকাসের সেনাবাহিনী উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হল।

তাঁর আগমনের সংবাদে ভীত হয়ে রোমান সিনেট ক্রেসাস-এর অধীনে বিরাট সৈন্যদল সমবেত করল। তারা স্পার্টাকাসের বাহিনীকে বাধা দিতে প্রস্তুত হল। স্পার্টাকাস কিন্তু রোম আক্রমণ না করেই দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চললেন। পথিমেধ্যে রোমান বাহিনীর দু’-একটি দলের সাথে খণ্ডযুদ্ধ হয়। তদের পরাজিত করে স্পার্টাকাসবাহিনী শেষ পর্যন্ত ইতালির সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এসে উপস্থিত হয়। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল সিসিলিতে গমন করা।

কিন্তু জাহাজ যোগাড় করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কাঠের ভেলায় সমুদ্র পার হওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হযে যায় প্রচণ্ড ঝড়ের আক্রমণে। ইতিমধ্যে ক্রেসাস-এর বাহিনী উপস্থিত হয়ে তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। নিরুপায় হয়ে স্পার্টাকাস যুদ্ধে লিপ্ত হলেন রোমান বাহিনীর সাথে। খ্রিস্টপূর্ব ৭১ অব্দে রোমানদের সাথে যুদ্ধে স্পার্টাকাসের ক্রীতদাসবাহিনী শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়।  স্পার্টাকাস শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাহসিকতার সথে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেন।

রোমানরা শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও এ যুদ্ধে তাদের প্রচুর ক্ষতি হয় ইতিমধ্যে পম্পির নেতৃত্বে রোমানদের আরেকটি বাহিনী বলকান উপদ্বীপ থেকে এসে পৌঁছায়। তারা মৃতপ্রায়, আহত ক্রীতদাসদের ধরে ধরে ক্রুশে বিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখে। বিদ্রোহের অগ্নি যেখানে প্রথম প্রজ্জ্বলিত হয়, সেই কাপুয়া শহর থেকে রোম পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তার দু ধারে খুঁটি পুঁতে এভাবে প্রায় ছয় হাজার ক্রীতদাসকে ঝুলিয়ে দেয়া হল বিভীষিকা সৃষ্টির জন্য। যাতে ভবিষ্যতে আর কখনও দাসবিদ্রোহ না ঘটে।

 

 

কিন্তু এত করেও রোম তার সংকটকে এড়াতে পারল না। যে সংকটের বীজ রোম নিজে বপন করেছিল ক্রীতদাসপ্রথাকে টিকিয়ে রেখে, তা শেষ পর্যন্ত তার নিজেরই পতন ডেকে এনেছিল।

আরও দেখুন :

রোমের গ্রহযুদ্ধ মারিয়াস ও সুলা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় রোমের গ্রহযুদ্ধ মারিয়াস ও সুলা

রোমের গ্রহযুদ্ধ মারিয়াস ও সুলা

 

 

রোমের গ্রহযুদ্ধ মারিয়াস ও সুলা

এতদসত্ত্বেও রোমের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হত, যদি রোম তার সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিত্যাগ করত। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃত পরিধি তাকে অনবরত প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে বাধ্য করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১১১ অব্দে উত্তর আফ্রিকার মিডিয়া রাজ্যের রাজা জুগার্থার বিরুদ্ধে রোম যুদ্ধে লিপ্ত হল।

এর পরপরই আক্রমণকারী গলদের বিরুদ্ধে এবং এশিয়া মাইনরে রোমের কুশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুযোগ নিয়ে অগ্রসররত পন্টাস রাজ্যের মিথ্রিডেটিস-এর বিরুদ্ধে রোম অভিযান প্রেরণ করে। এ সব যুদ্ধে জয়লাভকারী সামরিক নেতৃবর্গ একা একটি রাজনৈতিক দলের অধিকর্তারূপে রোমে আবির্ভূত হন।

সামরিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন মারিয়াস যিনি শুধু জুগার্থার বিরুদ্ধে জয়ী হননি, উত্তরের বর্বর জাতি কিম্ব্রি ও টিউটনদের সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকেও রোমকে রক্ষা করেন। এ কারণেই তিনি বিপুল জনপ্রিয় হন এবং পরপর ছয় বার রোমের কন্সালপদে নিযুক্ত হন। কন্সাল নিযুক্ত হওয়ার পরে মারিয়াস রোমের সৈন্যবাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেন। এতদিন পর্যন্ত সম্পদশালী লোকজনই শুধুমাত্র সৈন্যবাহিনীতে নিযুক্ত হতে পারত।

মারিয়াস এখন থেকে ভূমিহীন নাগরিকদেরও সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করার সুযোগ দান করেন। এর ফলে সৈন্যদের মধ্যেও তাঁর জনপ্রিয়তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় এবং প্রধানত এর সাহায্যেই তিনি ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেন। মারিয়াস যে দলের নেতৃত্ব দান করেন তারা ছিল প্রধানত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দরিদ্র ও মধ্য কৃষক এবং শ্রমিক ও কারিগর। কিন্তু রাষ্ট্রনায়করূপে মারিয়াস ব্যর্থতার পরিচয় দেন এবং নিজের দলের প্রতি শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করেন।

মারিয়াস-এর ব্যর্থতা রোমের চরম প্রতিক্রিয়াশীল দলকে শক্তিশালী করে তোলে; তারা ছিল প্রধানত দাসমালিক, বড় বড় ল্যাটিফন্ডিয়ার অধিকর্তা এবং অভিজাত বংশোদ্ভূত। রোমের সিনেটের অধিকাংশই ছিলেন এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এ দলের নেতৃত্ব দান করেন সামরিক অধিনায়ক সুলা। খ্রিস্টপূর্ব ৮৮ অব্দে সুলা রোমের কন্সাল নিযুক্ত হন এবং রোম এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়। মারিয়াস-এর বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে সুলা প্রাথমিকভাবে জয়লাভ করেন।

রোমের এই গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে পন্টাস-এর রাজা মিথ্রিডেটিস নিজেকে এশিয়া মাইনর, ম্যাসিডোনিয়া ও গ্রীসের অধিকর্তারূপে ঘোষণা করেন। পূর্ব দিকে রোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে। মিথ্রিডেটিস-এর বিরুদ্ধে অভিযানের নেতৃত্বের ভার মারিয়াস অথবা সুলা॥ কাকে দেয়া হবে, এ নিয়ে রোমে তীব্র সংঘাতের সূচনা হয়। উভয় পক্ষই সশস্ত্র সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মারিয়াস তখন সত্তর বছরের বৃদ্ধ, তাঁর পক্ষে জয়লাভ করা একপ্রকার অসম্ভব বলেই বিবেচিত হয়।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অন্যদিকে সুলা তখন ইতালিতে অবস্থান করছিলেন। সংবাদ পেয়ে সসৈন্য তিনি রোমের দিকে অগ্রসর হলেন এবং বিরাট বাহিনী নিয়ে রোমে প্রবেশ করলেন। তাঁকে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়ে মারিয়াস পলায়ন করেন। রোমে নিজের শক্তিকে সংগঠিত করে সুলা মিথ্রিডেটিস-এর বিরুদ্ধে অভিযানে অগ্রসর হন এবং তিন বছর ধরে বিভিন্ন যুদ্ধে মিথ্রিডেটিসকে পরাজিত করে তিনি গ্রীস অধিকার করে নেন।

মিথ্রিডেটিস সন্ধি প্রার্থনা করেন এবং সুলাও অনতিবিলম্বে মিথ্রিডেটিস-এর সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। কারণ ইতিমধ্যে রোমে তাঁর অনুপস্থিতিতে মারিয়াস-এর দল পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। মিথ্রিডেটিসের বিরুদ্ধে অভিযান সমাপ্ত করেই সুলা তাঁর সামরিক বাহিনী নিয়ে রোমের দিকে অগ্রসর হলেন। ইতালিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সৈন্যবাহিনী বাধাপ্রাপ্ত হল মারিয়াসের সৈন্যদল কর্তৃক। মারিয়াস অবশ্য এর আগেই মারা যান।

শুরু হল পুনরায় গৃহযুদ্ধ। কিন্তু অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সৈন্যদলের সাথে পেরে উঠতে না পারার ফলে মারিয়াসের দল পরাজয় বরণ করে। সুলার অধীনস্থ সৈন্যদল বিপুল বিক্রমে রোমে প্রবেশ করল এবং ইতিহাসে অতুলনীয় নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সূচনা করল। সুলা তাঁর বিরুদ্ধাচারীদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করার নির্দেশ দেন এবং হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করার সংকল্প ঘোষণা করেন। ইতালি, সিসিলি, স্পেন ও আফ্রিকাতে এভাবে লক্ষ লক্ষ নাগরিককে সুলার শত্রুরূপে চিহ্নিত করে হত্যা করা হল।

রোমের সিনেট সুলার সমস্ত কার্যকলাপকেই অনুমোদন দান করে তাঁকে রোমের একনায়করূপে বহাল করল। প্রতিদানে সুলা দেশের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নিশ্চিহ্ন করে একমাত্র সিনেটকেই সকল ক্ষমতা প্রদান করলেন। সুলার প্রতিষ্ঠিত শাসনতন্ত্র তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যক্ত হয়; কিন্তু সিনেটের পক্ষে সম্বব হল না দেশের উপযোগী আরেকটি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা। ফলে দেশে সৃষ্টি হল চরম অরাজকতা।

 

 

অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক সৈন্যদলের উপস্থিতি এবং তাদের শৃঙ্খলা বিবর্জিত কার্যকলাপ প্রতি মুহূর্তে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশকে বিনষ্ট করছিল। উপরন্তু সুলার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অন্যান্য সামরিক অধিনায়কবৃন্দের প্রত্যেকেই চেষ্টা করছিলেন যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা দখল করে দেশে নিজস্ব সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে। ফলে রোম আরেকবার গৃহযুদ্ধে ব্যাপৃত হয়ে পড়ল।

আরও দেখুন :

কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল

কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল

 

 

কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল

কার্থেজের বিরুদ্ধে জয়লাভ রোমের জন্য অন্যদিকে অভিযানের পথ খুলে দেয়। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অন্যান্য দেশগুলি এখন রোমের আগ্রাসী নীতির স্বরূপ প্রকাশ পাওয়ায় নিজেদের নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সময় ম্যাসিডনের রাজা পঞ্চম ফিলিপ কার্থেজের সাথে মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি সিরিয়ার সাথে একত্রে মিলে মিশরকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করেন।

ফিলিপের এই পরিকল্পনায় বাধাদানের উদ্দেশ্যে রোম পূর্ব দিকে তার সামরিক অভিযান প্রেরণ করে। ফলে গ্রীস ও এশিয়া মাইনর তার সরাসরি দখলে আসে এবং মিশরের উপর তার কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। গ্রীস জয়ের ফলে রোম হেলেনীয় সভ্যতার সংস্পর্শে আসে এবং বিপুল প্রতিরোধ সত্ত্বেও হেলেনীয় সংস্কৃতি ও ভাবধারা বহুলাংশে রোমানদের প্রভাবিত করে।

যুদ্ধজয়ের সম্পদ হিসাবে রোম ১,২৮০টি হাতির দাঁত, ২৩৪টি স্বর্ণহার, ১৮৭ হাজার পাউন্ড রূপা, ২ লক্ষ ২৪ হাজার গ্রীক রৌপ্যমুদ্রা, ১ লক্ষ ৪০ হাজার ম্যাসিডনীয় স্বর্ণমুদ্রা এবং প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলঙ্কার লাভ করে। এ ছাড়া কার্থেজবিজয়ের ফলে স্পেনের রূপার খনিগুলির অধিকারী হওয়ায় রোম প্রচুর পরিমাণে রৌপ্যমুদ্রা তৈরির সুযোগের অধিকারী হয়। কিন্তু রোমের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে পিউনিক যুদ্ধের যে প্রভাব পড়ে, সেটাই সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।

যুদ্ধের পরে বিপুলসংখ্যক যুদ্ধবন্দীদের ধরে আনা হয় এবং ক্রীতদাসরূপে তাদের উৎপাদনের সর্বস্তরে নিয়োগ করা হয়। ফলে ক্রীতদাসের সংখ্যা রোমে এত বেড়ে যায় যে, খনিতে, খামারে, কারখানায় স্বাধীন নাগরিকদের উচ্ছেদ করে এদেরই কাজে লাগানো হয়। গ্রামের স্বাধীন কৃষকদের উচ্ছেদ করে ছোটখাট কৃষিজমিগুলিকে একত্রিত করে বড় বড় ল্যাটিফান্ডিয়া বা কৃষি-খামার স্থাপন করা হল এবং সেখানে ব্যাপক হারে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করা হলো।

খনি ও কারখানায় বেতনভোগী মজুরদের পরিবর্তে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করা হল। ফলে দেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। এসব বেকার, অসহায়, ভবঘুরেরা রোমে এসে জড়ো হয় এবং সামাজিক জীবনে এক প্রচণ্ড সমস্যার সৃষ্টি করে। বিজিত রাজ্যগুলি থেকে সস্তা দরে খাদ্যদ্রব্য আমদানির ফলে দেশে প্রস্তুত খাদ্যদ্রব্যের দাম ভীষণভাবে কমে যায় এবং কৃষকরা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দেশে ব্যবসায়ী, মহাজন, ঠিকাদার ইত্যাদি এক শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগীর আবির্ভাব হয় এবং দেশের সম্পদের একটি অংশ এদের কুক্ষিগত হয়। সবচেয়ে বড় কথা হল যে, যুদ্ধজয়ের সম্পদলাভের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন ইত্যাদি রোমে এসে জমা হলো তাতে এক শ্রেণীর লোক প্রচণ্ড ভোগবিলাসে নিমগ্ন হয়ে পড়লো। এসবের ফলে রোমে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের দারুণ পরিবর্তন ঘটল।

একটি স্বাধীন নাগরিকদের রাষ্ট্রের পরিবর্তে রোম পরিণত হল সাম্রাজ্যবাদী দাসনির্ভর রাষ্ট্রে। ক্রীতদাসদের পশুর মতো শ্রমে নিযুক্ত করে রোমে যেমন একদিকে স্বাাধীন নাগরিকদের জীবিকার পথ বন্ধ করে দেযা হল, অন্যদিকে তেমনি এক শ্রেণীর লোক সর্বপ্রকার দৈহিক শ্রম থেকে বিরত হয়ে প্রচণ্ড বিলাসিতা ও অর্থনৈতিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য এতদিনের সমস্ত মূল্যবোধ ও ধ্যান ধারণাকে পাল্টে দিল, শৃঙ্খলাবোধ ও দেশপ্রেম এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য॥

যা এতদিন পর্যন্ত রোমের জনগণের মধ্যে টিকে ছিল, তা এখন বিশৃঙ্খলা, ঈর্ষা, পরস্পরের প্রতি রেষারেষি ও শত্রুতায় পরিণত হল। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে এ বিশৃঙ্খলা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উপনীত হল এবং সিনেটর ক্যাটোর মতো দু-একজন বিচক্ষণ ব্যক্তির সতর্কবাণী ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা ব্যাপক ভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। রোমের সাম্রাজ্যবাদী নীতির পরিণামস্বরূপ প্রাথমিকভাবে রোমে যে অশান্তি ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়, তা শেষ পর্যন্ত রোম প্রজাতন্ত্রের জন্য মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

গুপ্তহত্যা, শাসকশ্রেণীর নিজেদের মধ্যে রেষারেষি, যুদ্ধ, গৃহবিবাদ ইত্যাদির সাথে যুক্ত হয় দাসবিদ্রোহ— যা ব্যাপকভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ক্রীতদাসপ্রথা শুধু রোমের স্বাধীন অর্থনীতিকেই ব্যাহত করেনি, ক্রীতদাসদের মানবেতর জীবনযাপন, তাদের প্রতি সীমাহীন অত্যাচার ইত্যাদির কারণে প্রায়শই ব্যাপক দাসবিদ্রোহ সংঘটিত হয়— যা রোম প্রজাতন্ত্রের তথাকথিত শান্তিকে প্রায়ই বিঘ্নিত করত।

খ্রিঃ পূঃ ১০৪ অব্দে প্রথম ব্যাপক দাসবিদ্রোহ শুরু হয় সিসিলিতে। রোমান সৈন্যের সাহায্যে এ বিদ্রোহ দমন করা হয়। ত্রিশ বছর পরে সিসিলিতে দ্বিতীয় বারের মতো ক্রীতদাসগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এবারও রোমান সৈন্য পাঠিয়ে এ বিদ্রোহ দমন করা হল। ক্রীতদাসপ্রথার কুফল রোমের কিছুসংখ্যক নাগরিককে এর ভয়াবহতা সম্বন্ধে সচেতন করে তুলেছিল। এদের মধ্যে দুইজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তাঁরা হলেন প্লিবিয়ান শ্রেণী থেকে উদ্ভূত গ্রাকাস্ ভ্রাতৃদ্বয় । বড় ভাই টাইবেরিয়াস গ্রাকাস খ্রিঃ পূঃ ১৩৩ অব্দে রোমের ট্রিবিউন নিযুক্ত হন। তিনি জমিসংক্রান্ত একটি সংশোধনী বিল সিনেটে উপস্থিত করেন। এতে প্রস্তাব করা হয় যে, কোনো ব্যক্তি ৩১০ একরের বেশি জমির মালিক হতে পারবে না। অবশিষ্ট জমি দেশের ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে।

টাইবেরিয়াসের উদ্দেশ্য ছিল ব্যাপকভাবে ক্রীতদাসদের কৃষিকার্যে নিযুক্তির ফলে যে বিপুলসংখ্যক স্বাধীন কৃষক ভূমিহীন হয়ে পড়েছিল তাদের অন্তত কিছুটা পুনর্বাসিত করা। কিন্তু সিনেটের বহু সদস্য এ বিলের বিরোধিতা করে। তারা প্রত্যেকেই ছিল বিরাট বিরাট কৃষি-খামারের মালিক এবং ক্রীতদাসদের অধিকর্তা। স্বভাবতই তাদের স্বার্থবিরোধী এ বিলকে তারা প্রাণপণে বাধা দেয়; তাদের নেতা অক্টেভিয়াস এ বিলের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করেন।

টাইবেরিয়াস অক্টেভিয়াসকে ট্রিবিউন পদ থেকে অপসারিত করেন এবং সিনেটে নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করে এ বিল পাস করেন। এ বিল কার্যকর করতে গিয়ে টাইবেরিয়াস প্রচণ্ডভাবে সর্বত্র বাধাপ্রাপ্ত হন। অক্টেভিয়াসকে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরিয়ে দেয়ার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। পরবর্তী ট্রিবিউন নির্বাচনে টাইবেরিয়াস অংশগ্রহণ করলে তাঁর বিরোধী পক্ষ নির্বাচনের দিন হিংসাত্মক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে টাইবেরিয়াস ও তাঁর ৩০০ অনুচরকে হত্যা করে।

টাইবেরিয়াস-এর মৃত্যুর নয় বছর পরে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা গেইয়াস গ্রাকাস বড় ভাই-এর আরব্ধ সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেন। ১২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গেইয়াস ট্রিবিউন নিযুক্ত হন। তিনি তাঁর ভাইয়ের চেয়ে বেশি স্পষ্ট বক্তা ছিলেন এবং সিনেটের বিভিন্ন কার্যকলাপের মারাত্মক সমালোচনা শুরু করেন। তিনি প্রস্তাব করেন যে, টাইবার নদীর পার্শ্বে সরকারি শস্যাগার গড়ে তুলতে হবে এবং সেখান থেকে স্বল্প মূল্যে খাদ্যদ্রব্য দেশের দরিদ্র জনসাধারণের নিকট বিক্রি করতে হবে।

নির্যাতিত জনগণের মধ্যে ভীষণভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করার ফলে গেইয়াস পরের বছর পুনরায় ট্রিবিউন নির্বাচিত হন। এবার তিনি নাগরিক অধিকার, যা এতদিন পর্যন্ত শুধু রোমের জনগণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা ইতালির অন্যান্য জনগণ, বিশেষ করে ল্যাটিনদের মধ্যে বিস্তৃত করার প্রস্তাব দেন। গেইয়াস-এর শত্রুরা এবার প্রচার করতে শুরু করল যে, রোমানদের সম্পদের অধিকার এবার অন্য জাতিরাও কেড়ে নেবে।

 

 

এ প্রচারণা গেইয়াস-এর বিরুদ্ধে বিপুল জনমত গড়ে তুলল। গেইয়াসকে দেশের শত্রু ঘোষণা করা হল। গেইয়াস অবশ্য আত্মরক্ষার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত করেছিলেন কিন্তু পরাক্রমশালী রোমান সৈন্যবাহিনীর সাথে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। রোমান সৈন্যের হাতে মৃত্যুবরণের পরিবর্তে তিনি তাঁর একজন অনুচরকেই নির্দেশ দেন তাঁকে মেরে ফেলার জন্য। কিন্তু রোমান সৈন্যরা তাঁর তিন হাজার অনুচরকে হত্যা করে।

গ্রাকাস্ ভ্রাতৃদ্বয়ের হত্যা একটি কথাই পরিস্ফুট করে তোলে যে, রোমের তথাকথিত গণতন্ত্রের মৃত্যুঘন্টা বাজছে, রোমের দাস-মালিকগণ এতটুকু স্বার্থত্যাগ করতে রাজি নয়, এবং বৃহত্তর জনগণের কল্যাণ কামনা তাদের মোটেই কাম্য নয়— বরং দরকার হলে বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই তারা জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম দমন করবে।

আরও দেখুন :

কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযান

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযান। ১৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম পিউনিক যুদ্ধের শেষের পঞ্চাশ বছর আগে কার্থেজ রোমে তার ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করেছিল এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করছিল, কিন্তু রোমের জন্য কোনো সামরিক হুমকি ছিল না।তা সত্ত্বেও, রোমান সিনেটের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটি দল ছিল যারা কার্থেজের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিল।একটি অজুহাত হিসাবে অবৈধ Carthaginian সামরিক পদক্ষেপ ব্যবহার করে, রোম একটি শাস্তিমূলক অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে।কার্থাজিনিয়ান দূতাবাসগুলি রোমের সাথে আলোচনার চেষ্টা করেছিল, যা তুচ্ছভাবে সাড়া দিয়েছিল।উত্তর আফ্রিকার বৃহৎ বন্দর শহর উটিকা, কার্থেজ থেকে প্রায় ৫৫ কিমি (৩৪ মাইল) উত্তরে, ১৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে চলে যায়।সচেতন যে Utica এর পোতাশ্রয় কার্থেজের উপর যেকোন আক্রমণের জন্য ব্যাপকভাবে সাহায্য করবে, সেনেট এবং রোমের পিপলস অ্যাসেম্বলি কার্থেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযান

 

 

কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযান

মগ্র ইতালির অধীশ্বর হওয়ার পর রোমের স্বভাবতই দৃষ্টি পড়ে ভূমধ্যসাগরের অপর পারে অবস্থিত উত্তর আফ্রিকার বিশাল সমৃদ্ধিশালী নগরী কার্থেজের উপর। কার্থেজ নগরীকে শুধু নগরী বললে ভুল বলা হবে, প্রকৃতপক্ষে কার্থেজ ছিল একটি বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারী। উত্তর আফ্রিকার টিউনিস্ থেকে জিব্রাল্টার প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডের মালিকানা ছিল কার্থেজের অধীনে।

৮০০ অব্দে ফিনিসীয় উপনিবেশরূপে কার্থেজ নগরীর পত্তন হয়। খ্রিঃ পূঃ ৬০০ অব্দে কার্থেজীয়গণ তাদের মাতৃভূমির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একটি স্বাধীন শক্তিশালী ও সম্পদশালী জাতিরূপে গড়ে উঠে। কার্থেজের এই সমৃদ্ধির মূলে ছিল ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলস্থ বাণিজ্যবন্দরগুলির সাথে পরিচালিত ব্যবসা-বাণিজ্য।

স্পেন ও ব্রিটেনের রূপা ও তামার খনিগুলির সম্পদ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে ও উত্তর আফ্রিকার অধীনস্থ এলাকাগুলির সম্পদ আত্মসাৎ করে কার্থেজ তার নিজস্ব পণ্যের সম্ভার গড়ে তোলে এবং এই পণ্য দেশ-বিদেশে চালান দিয়ে সে তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। স্বাভাবিক কারণেই কার্থেজের বিপুল ঐশ্বর্য রোমের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই কার্থেজের সাথে রোমের তিনটি বিরাট যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধগুলিকে পিউনিক যুদ্ধ বলা হয়।

কার্থেজের অধিবাসীদের রোমানগণ পিনি (অর্থাৎ ফিনিশীয়) নামে সম্বোধন করত। এই নাম থেকেই পিউনিক নামের উৎপত্তি। খ্রিঃ পূঃ ২৬৪ অব্দে কার্থেজের সাথে রোমের প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রাথমিক কারণ ছিল সিসিলির উপর উভয়ের দখল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। কার্থেজ অবশ্য সিসিলির পশ্চিমাংশ আগেই অধিকার করে নিয়েছিল। এখন সে পূর্ব দিকের গ্রীক অধিকৃত সায়রাকিউজ ও মেসানার উপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।

কার্থেজের হাত থেকে সিসিলিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রোম কার্থেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তেইশ বছর স্থায়ী যুদ্ধে কার্থেজ শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় এবং সিসিলির অধিকার রোমের হাতে প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রচুর ধনরত্নও রোমকে প্রদান করতে হয়।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সিসিলি দখলের পর রোমের লালসা আরও বেড়ে যায়। কার্থেজ কর্তৃক স্পেনে রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টাকে রোম তার উপর কার্থেজের আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা বলে মনে করে এবং কার্থেজের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ ঘোষণা করে (২১৮ খ্রিঃ পূঃ)। এ যুদ্ধ সতেরো বছর ধরে চলে। কার্থেজীয়গণ তাদের বিখ্যাত সামরিক অধিনায়ক হ্যানিবল-এর অধীনে আপ্লস্ পর্বত অতিক্রম করে রোমের দিকে অগ্রসর হয়।

হ্যানিবল-এর বাহিনী ক্যানির যুদ্ধে (২১৬ খ্রিঃ পূঃ) রোমানদের পরাজিত করে সমগ্র ইতলীয় উপদ্বীপব্যাপী এক প্রচণ্ড বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। রোম তার মিত্রদের সহায়তায় বহু কষ্টে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু হ্যানিবল তাঁর নিজ দেশ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য ও সহযোগিতা না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ইতালী ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হন। শেষ যুদ্ধে হ্যানিবল রোমের হাতে পরাজিত হন এবং এ পরাজয় কার্থেজের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে।

যুদ্ধে বিধ্বস্ত ও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত কার্থেজ শুধু মাত্র তার রাজধানী ও তৎসংলগ্ন আফ্রিকার কিছু অংশ ব্যতীত সমগ্র অধিকৃত সাম্রাজ্য রোমের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। খ্রিঃ পূঃ দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোমের আগ্রাসী নীতি সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়। ইতিমধ্যে কার্থেজ তার পূর্ব সমৃদ্ধির কিছুটা পূনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এটা রোমের পক্ষে সহ্য করা কঠিন ছিল।

১৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমের সিনেট কার্থেজের প্রতি এই মর্মে নির্দেশ পাঠায় যে কার্থেজীয়গণ যেন তাদের রাজধানী পরিত্যাগ করে চলে যায় এবং সমুদ্রোপকূলের অন্তত দশ মাইলের মধ্যে তাদের কোনো চিহ্ন যেন না থাকে। একটি স্বাধীন জাতির পক্ষে এর চেয়ে অবমাননাকর আর কি হতে পারে? এ নির্দেশনামা ছিল কার্থেজীয়গণের প্রতি মৃত্যু-সংকেতস্বরূপ । স্বাভাবিকভাবেই কার্থেজীয়গণ এ নির্দেশ অমান্য করে এবং রোম তৃতীয় ও শেষবারের মতো তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

 

 

তিন বছর ধরে (খ্রিঃ পূঃ ১৪৯-১৪৬) কার্থেজীয়গণ প্রাণপণে প্রতিরোধ করেও শেষ পর্যন্ত রোমানদের হাতে পরাজিত হল। পৃথিবীতে যতগুলি নৃশংস মর্মান্তিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, এ যুদ্ধ তাদের অন্যতম। পরাজিত ও বিধ্বস্ত কার্থেজ নগরীর উপর রোমক বাহিনীর বিপুল জয়যাত্রা যে॥বিভীষিকার সৃষ্টি করে, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন লেখা থাকবে।

পাইকারি গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পর যারা অবশিষ্ট ছিল, তাদের ক্রীতদাসরূপে রোমে চালান দেওয়া হল। এককালের সমৃদ্ধিশালী কার্থেজ নগরীর কোনো চিহ্নমাত্র রইল না। রোমান সিনেট সদস্য ও দাসমালিকগণ অধিকৃত অঞ্চলের সমৃদ্ধ এলাকাগুলি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিল।

আরও দেখুন :

নৃবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, সামাজিক নৃবিজ্ঞান, জৈবিক নৃবিজ্ঞান

Exit mobile version