আজকের আলোচনার বিষয় অর্থশাস্ত্র এবং অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান – যা অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু এর অর্ন্তভুক্ত, অনেকেই অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান বলতে অর্থনীতি বা অর্থশাস্ত্র এবং নৃবিজ্ঞানের সমন্বয় হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু আপনারা ইতোমধ্যেই জানেন যে ইউরোপের নৃবিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে সেইসব সমাজ পর্যবেক্ষণ এবং পর্যালোচনা করেছেন। নৃবিজ্ঞান নামক জ্ঞানকান্ডটির সূচনা এভাবেই ঘটেছে। সেসব নৃবিজ্ঞানীরা প্রথমেই লক্ষ্য করেছেন প্রচলিত অর্থশাস্ত্র থেকে এইসব সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাদ পড়ে গেছে।
নৃবিজ্ঞানীরা যখন আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন সমাজে গবেষণা করতে যান তখন তাঁরাও ভাবতেন যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বলতে যা বোঝায় তা কেবল পশ্চিমের (ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) সমাজেই আছে। কিন্তু নিজেদের কাজ করতে গিয়ে তাঁদের উপলব্ধি জন্মায় যে এই সকল অপশ্চিমা সমাজের নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক কর্মকান্ড রয়েছে। আর তা কতকগুলি নির্দিষ্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। এভাবে আর্থব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদের অর্থশাস্ত্রের পরিধির বাইরে চিন্তা-ভাবনা জন্মে ।
অর্থশাস্ত্র এবং অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান
নৃবিজ্ঞানের প্রথম কালে, বিংশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত, যখন আমরা ‘অর্থনৈতিক- নৃবিজ্ঞান’ নামে কোন শাখার কথা জানি না তখনও নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণা কাজে অপশ্চিমা সমাজের বা ইউরোপের বাইরের সমাজের নানানভাবে অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে এসেছে। বলা চলে, নৃবিজ্ঞানীরা তাঁদের এথনোগ্রাফিতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়েও আলোকপাত করেন। এখানে আমরা বহুল পরিচিত নৃবিজ্ঞানী ব্রনিল ম্যালিনোস্কির নামও উল্লেখ করতে পারি। তিনিও তাঁর বিখ্যাত বই (এথনোগ্রাফি) আরগোনাট্স অব দ্য ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক-এ ট্রব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা ও ব্যাখ্যা করেছেন।
এভাবে অর্থশাস্ত্রের পরিধির বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক- নৃবিজ্ঞানের সূচনা ঘটে। যদিও. আগেই উল্লেখ করেছি যে এই ধারণাটি একটা শাখা হিসেবে চিহ্নিত হয় আরও পরে। যাই হোক, চল্লিশ পঞ্চাশের দশক থেকে নৃবিজ্ঞানে প্রধান একটা বিতর্ক দেখা দেয় প্রচলিত অর্থশাস্ত্র আদৌ ইউরোপের শিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজের বাইরের সমাজের জন্য প্রযোজ্য কিনা। অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র যে তত্ত্ব এবং পদ্ধতি নিয়ে কাজ করে থাকে তা দিয়ে অপশ্চিমের ঐ সমাজগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বোঝা যায় কিনা।
নৃবিজ্ঞানীদের অনেকে তখন প্রচলিত অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব ও পদ্ধতিকে সকল সমাজের জন্য সমানভাবে কার্যকরী মনে করলেও বড়সড় চ্যালেঞ্জ আসতে শুরু করে অন্য কিছু নৃবিজ্ঞানীর কাজের মাধ্যমেই। এই বিতর্ক চলতে চলতেই নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁরা মার্ক্সবাদী পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা একেবারে ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক- নৃবিজ্ঞান চালু করলেন। এভাবে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান খুব সহজেই নানান তত্ত্ব ও তর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল।
একটা ব্যাপারে এই সকল তাত্ত্বিক ধারার মিল ছিল। তা হচ্ছে: প্রতিটি ধারাই বিভিন্ন সমাজের প্রত্যক্ষ উদাহরণ হাজির করেছে। ফলে উভয় পক্ষই তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে মাঠ পর্যায়ের উদাহরণ হাজির করেছেন। পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক- নৃবিজ্ঞান কেবল অপশ্চিমা সমাজ বা ভারী শিল্পবিহীন সমাজ (প্রথম যুগের নৃবিজ্ঞানীদের ভাষায় সরল সমাজ) নিয়েই কাজ করেনি। বরং বর্তমানে শিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজের নানাবিধ কর্মকান্ড, আচরণ এবং অনুশীলন নিয়ে অর্থনৈতিক- নৃবিজ্ঞান কাজ করেছে। সংক্ষেপে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের পরিচয় এখানে তুলে ধরা হ’ল:
ক) প্রচলিত অর্থশাস্ত্র যে সকল সমাজের উপর মনোযোগ দেয় (পশ্চিমা সমাজ কিংবা বাজারভিত্তিক সমাজ/শিল্পভিত্তিক সমাজ/পুঁজিবাদী সমাজ) অর্থনৈতিক- নৃবিজ্ঞান তার বাইরের পরিসরে কাজ করতে শুরু করেছে। অর্থাৎ অর্থশাস্ত্রে বাদ পড়ে গেছে যে সব সমাজ তা নিয়েই এই শাখার যাত্রা শুরু। সেদিক থেকে বিষয়বস্তুর ভিন্নতার মাধ্যমে অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক- নৃবিজ্ঞানের পার্থক্য রয়েছে।
খ) পৃথিবীর সকল সমাজেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও কর্মকান্ড আছে – এই উপলব্ধি নিয়েই – অর্থনৈতিক -নৃবিজ্ঞান কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন সমাজের আর্থনীতিক কর্মকান্ডের মধ্যে নানা ধরনের ভিন্নতা আছে। কিন্তু কেবল পুঁজিবাদী সমাজের কর্মকান্ডকেই অর্থনৈতিক বলে ভাবার বিরোধিতা করে অর্থনৈতিক -নৃবিজ্ঞান ।
গ) পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝার জন্য প্রচলিত অর্থশাস্ত্রে যে সব তত্ত্ব ও পদ্ধতি দেখা দিয়েছে তা দিয়ে অন্যান্য সমাজ বোঝা যাবে কিনা তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক দেখা দিয়েছে এই শাখায় ।
ঘ) বর্তমান কালের অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান নগরভিত্তিক এবং গভীরভাবে বাজারভিত্তিক সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়েও অধ্যয়ন করে থাকে। তবে এখানে মনে রাখা দরকার বর্তমান কালে নৃবিজ্ঞানের এই শাখাটির আর আগের মত গুরুত্ব নেই – যেমন ছিল ৫০, ‘৬০ বা ‘৭০-এর দশকে। – এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন চলে আসে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বলতে কি বোঝায়। নিচের আলোচনার মাধ্যমে সেই বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।
অর্থনৈতিক সংগঠন সূচিপত্র:
অর্থনৈতিক সংগঠন সূচিপত্র, অর্থনৈতিক সংগঠন নিয়ে সকল আর্টিকেল এর লিংক এইখানে পেয়ে যাবেন যা প্রতিনিয়ত আপডেট হতে থাকে। সমাজের অর্থনৈতিক সংগঠন নিয়ে আলোচনা করা হয় নৃবিজ্ঞানের যে শাখায় তাকে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান বলা হয়ে থাকে। শিল্পভিত্তিক সমাজ নয় যেগুলো, তা নিয়ে প্রথাগত অর্থশাস্ত্রের তেমন আগ্রহ ছিল না। তার মানে অর্থশাস্ত্রের আলোচনা ছিল মূলত ইউরোপ নিয়ে, পরবর্তী কালে উত্তর আমেরিকার সমাজ নিয়ে। এছাড়া অবশ্য উপনিবেশের সময়কালে এবং পরবর্তী কালে গঠিত রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়েও অর্থশাস্ত্রের আগ্রহ দেখা দিয়েছে। কিন্তু নৃবিজ্ঞানের পরিধিতে অন্যান্য সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং সংগঠন নিয়ে মনোযোগ দেয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু এবং গুরুত্ব
- অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু এবং গুরুত্ব
- অর্থশাস্ত্র এবং অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান
- অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও আর্থব্যবস্থা
- প্রথাবাদী আর বাস্তববাদী বিতর্ক
- মার্ক্সবাদী ধারা
- সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের সম্ভাবনা
- অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু এবং গুরুত্ব অধ্যায়ের সারাংশ
প্রাক্ পুঁজিবাদী ‘আর্থব্যবস্থা
- প্রাক্ পুঁজিবাদী ‘আর্থব্যবস্থা
- শিকারী সংগ্রহকারী সমাজ
- পশুপালক সমাজ
- উদ্যান কৃষি সমাজ
- নিবিড় কৃষি সমাজ এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় বদল
- প্রাক্ পুঁজিবাদী আর্থব্যবস্থা অধ্যায়ের সারাংশ
বিনিময় এবং বণ্টন